কেন কানাডায় ট্রুডো যুগের অবসান: বিবিসি

আন্তর্জাতিক জনপ্রতিনিধি তথ্য-প্রযুক্তি পুরুষ প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

কয়েক মাস ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছিলেন: ‘আপনি কি পদত্যাগ করবেন?’

তবে ভোটারদের হতাশা ক্রমাগত বাড়তে থাকার পরও লিবারেল পার্টির নেতার পদটি আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন ট্রুডো। বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বৈরিতা ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি নিজেকে ‘যোদ্ধা’ বলা ট্রুডো নিজ দলের ভেতরেই বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। নিজ দলের সদস্যদের অনেকে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় বাসভবন রিডাউ কটেজের সামনে দেওয়া বক্তব্যে ট্রুডো পদত্যাগের ঘোষণা দেন। বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে দেশের জন্য সত্যিকারের পছন্দের ব্যক্তিটিকে প্রয়োজন। আর আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আমাকে যদি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তবে আমি ওই নির্বাচনে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী হতে পারব না।’

ঘোষণা অনুযায়ী, নিজ দল লিবারেল পার্টি তাদের নতুন নেতা বেছে না হওয়া পর্যন্ত ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন। দলীয়ভাবেই নতুন নেতা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।

নতুন নেতা খুঁজতে দলকে সময় দিতে ট্রুডো আগামী মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত রাখার কথা বলেছেন।

প্রগতিশীল রাজনীতির নতুন মুখ হিসেবে প্রায় এক দশক আগে ক্ষমতায় আসেন ট্রুডো। ২০১৫ সালে তাঁর তারুণ্যের চমক এবং আশাব্যঞ্জক রাজনৈতিক বার্তায় প্রভাবিত হন ভোটারেরা। তাঁরা বিপুল ভোট দিয়ে লিবারেলদের তৃতীয় স্থানের দল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পার্লামেন্টে অধিষ্ঠিত করে, যা কানাডার রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ট্রুডো যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বারাক ওবামা, আঙ্গেলা ম্যার্কেল, শিনজো আবে এবং ডেভিড ক্যামেরনের মতো বিশ্বনেতারা শাসনক্ষমতায় ছিলেন। সমসাময়িক এসব নেতা একে একে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও ট্রুডো তাঁর পদে বহাল থাকেন। ৫৩ বছর বয়সী ট্রুডো এখন জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা নেতা।

বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে অভিষেক হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোয় এবং দেশটিতে অনুষ্ঠিত দুটি সাধারণ নির্বাচনে ট্রুডো তাঁর দলের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলেন।

কানাডার রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিক এবং ‘জাস্টিন ট্রুডো অন দ্য রোপস’-এর লেখক পল ওয়েলস সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ‘একজন ফলপ্রসূ’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন, জলবায়ু নীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে স্মরণ করা হবে। কিন্তু তিনি আবার এমন একজন মানুষও, যিনি ক্রমশ জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না।

গতকাল সোমবার দেওয়া বক্তব্যে ট্রুডো তাঁর শাসন মেয়াদে কী কী উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, সেগুলো তুলে ধরেছেন। কোভিড মহামারিকালের পরিস্থিতি সামলানো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন আগের মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা এবং এবং শিশুদের জন্য সুবিধা ভাতা চালুর মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করেন তিনি। শিশুদের জন্য ওই সুবিধা দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

তবে বেশ কয়েকটি নৈতিক কেলেঙ্কারির কারণে ট্রুডো সরকারের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। এসএনসি-লাভালিন দুর্নীতির তদন্তে এবং বাহামায় বিলাসবহুল ভ্রমণের জন্য কেন্দ্রীয় স্বার্থের সংঘাতজনিত বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

২০২০ সালে বড় একটি সরকারি কর্মসূচি পরিচালনা করতে নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি দাতব্য সংস্থাকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন ট্রুডো।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। সেবার ক্ষমতায় থাকতে লিবারেলদের অন্যান্য দলের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ২০২১ সালের আগাম নির্বাচনও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি।

খুব সম্প্রতি দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্র করে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন ট্রুডো।

ওয়েলস মনে করেন, বড় বড় প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারা নিয়ে ট্রুডোর প্রতি জনগণের হতাশা আছে। অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো সামাল না দিতে পারা নিয়েও তাদের হতাশা আছে।

গত বছরের শেষের দিকে লিবারেলরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিবাসন পরিকল্পনাগুলো থেকে সরে আসে। বিশেষ করে কানাডায় নতুন আসা মানুষের সংখ্যা কমানোর মতো পরিকল্পনাগুলোর অব্যবস্থাপনাজনিত উদ্বেগকে কেন্দ্র করে তারা সরে আসে।

একের পর এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডোর বিদায় ঘণ্টা বাজছে।

গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত কয়েকটি বিশেষ নির্বাচনে ভোটাররা লিবারেলদের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত আসনগুলোয় লিবারেল প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করে। এর মধ্য দিয়ে লিবারেল পার্টির ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়।

পেরেজ স্ট্র্যাটেজিসের অধ্যক্ষ এবং লিবারেল স্ট্র্যাটেজিস্ট অ্যান্ড্রু পেরেজ বিবিসিকে বলেছেন, ট্রুডোর যে ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখাটা এখন লিবারেলদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে।

ছুটির দিনগুলোতে অ্যাঙ্গাস রিড ইনস্টিটিউট পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, লিবারেল পার্টির প্রতি মানুষের সমর্থন কমে ২০১৪ সালের অবস্থায় পৌঁছেছে।

জরিপগুলো বলছে, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে ৪৫ বছর বয়সী পিয়েরে পোইলিয়েভরের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভরা সহজেই জয়ী হবে।

পরবর্তী নির্বাচন অবশ্যই অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। যদিও পোইলিয়েভর এবং কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং- দুজনই বলেছেন, মার্চে পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হওয়ার পর পরই তারা কানাডায় নির্বাচন চান।

কানাডায় এমন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হলো, যখন কি না দেশটি বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব নিলে কানাডার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করবেন। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে কানাডা।

এরপরও শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন ট্রুডো। নির্বাচনে মতাদর্শিক বিরোধী নেতা পোইলিয়েভরের মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎই উপ–প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের পদত্যাগের ঘটনাটি ছিল ট্রুডোর জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা। তখন ফ্রিল্যান্ড বলেছিলেন, ট্রাম্পের হুমকিকে গুরুত্বসহকারে না নেওয়াটা তাঁর ব্যর্থতা ছিল।

ট্রুডোর নিজ দলের সদস্যরা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁরা এখন তাঁর নেতৃত্বকে সমর্থন করেন না।

অর্থাৎ ট্রুডোর শেষ ভরাসাটুকুও আর থাকল না।

আরো পড়ুন : ৭ জানুয়ারি, আজকের দিনে জন্ম-মৃত্যুসহ যত ঘটনা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *