পদ্মা সেতুর চাপ নিতে প্রস্তুত নয় রাজধানী

ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের রাজধানী এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যাওয়ার পথ নেই। রাজধানী ঘিরে বৃত্তাকার পথ (ইনার সার্কুলার রুট) নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এসব যানবাহনকে শহরের ভেতর দিয়ে পদ্মা সেতুতে যেতে হবে। গাবতলী টার্মিনাল থেকে দক্ষিণবঙ্গের কোনো বাস আরিচা ঘাটের বদলে পদ্মা সেতু হয়ে যেতে চাইলে একই অবস্থায় পড়তে হবে।

আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুতে যান চলাচল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগকে সহজ ও দ্রুত করবে। কিন্তু রাজধানীর যানজট এড়িয়ে বিভিন্ন জেলার গাড়ি কীভাবে সেতুতে যাবে- এর জবাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে সেতু পার হয়ে দক্ষিণবঙ্গের গাড়ি দ্রুতই ঢাকা চলে আসবে। ফলে রাজধানীতে গাড়ির চাপ বাড়বে। অন্যদিকে, শহরের ভেতর দিয়ে পদ্মা সেতুতে গাড়ি গেলে যানজটের বিদ্যমান সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেবে।

আবদুল্লাহপুর-ধউর-বিরুলিয়া-গাবতলী-সোয়ারীঘাট-বাবুবাজার-কদমতলী-তেঘরিয়া-পোস্তগোলা-ফতুল্লা-চাষাঢ়া-হাজীগঞ্জ-ডেমরা হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত তথা ঢাকার চারদিকে ইনার সার্কুলার রুট নির্মাণের পরিকল্পনা করে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্ত। সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ এখনও অন্ধকার। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে অর্থায়নের জন্য প্রস্তাব করেছিল সওজ। কিন্তু চীনের ব্যাংকটি গত ছয় মাসে কোনো যোগাযোগই করেনি।

প্রকল্পের পরিচালক সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান সমকালকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়ন চলছে। এতে মাসছয়েক সময় লাগবে। প্রকল্পটি সরকারি অর্থায়নে (জিওবি) বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হবে।

ইনার সার্কুলার রুট হলে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি ঢাকা শহরকে এড়িয়ে যেতে পারত। একই সুবিধা পেত পদ্মা সেতুমুখী গাড়ি। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় (এসপিটি) সার্কুলার রুট নির্মাণের সুপারিশ ছিল। পরে ২০১৫ সালের সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) ঢাকাকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, আরএসটিপির অগ্রাধিকারের প্রকল্প ইনার সার্কুলার রুট। প্রস্তাবিত আটটি রেডিয়াল সড়কের একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে (এন-৮)। পদ্মা সেতুর ‘ফরওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে এ সড়ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক’ ইনার সার্কুলার রোড তৈরি হয়নি। সেতু চালুর পর খুব দ্রুত গাড়ি ঢাকায় আসবে। এর চাপ সামলানোর ক্ষমতা রাজধানীর নেই। চাপ সামলাতেই সার্কুলার রুটের দক্ষিণাংশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি শহরের ভেতর দিয়ে পদ্মা সেতুতে গেলে ‘শর্টসার্কিট’ হবে।

৮৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইনার সার্কুলার রুট দুটি ভাগে নির্মাণের পরিকল্পনা বহু বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথম ধাপের আওতায় আবদুল্লাহপুর রেলগেট থেকে তেরমুখ, পূর্বাচল, বেরাইদ, ডেমরা পর্যন্ত ২৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে নির্মাণ করার কথা। ইস্টার্ন বাইপাস নামে এ সড়ক নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে ডিপিপি করলেও কাজ এগোয়নি।

আবদুল্লাহপুর রেলগেট থেকে ধউর, বিরুলিয়া, গাবতলী, বছিলা, হাজারীবাগ, সোয়ারীঘাট, কদমতলী, তেঘরিয়া, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, শিমরাইল হয়ে ডেমরা পর্যন্ত ৬৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় সার্কুলার রুটের দ্বিতীয় ধাপের আওতায়।

তবে সাকল্যে সড়ক নির্মাণ করতে হবে ৪৭ দশমিক ১৪৭ কিলোমিটার। ১২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে পিডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সওজ। অবশ্য প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, এ হিসাব তিন বছরের পুরোনো। বর্তমান বাজার হিসেবে ব্যয় বাড়বে।

সওজের পরিকল্পিত ইনার সার্কুলার রুটের তেঘরিয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার পথ ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের অংশ। আবদুল্লাহপুর রেলগেট থেকে ধউর পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার পথ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) নির্মাণ করার কথা। যদিও বিবিএ পুরো বৃত্তাকার পথেই উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে চায়। এ নিয়ে সওজের সঙ্গে টানাপোড়েনও রয়েছে।

সওজের অগ্রাধিকারে রয়েছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ গাবতলী থেকে কেরানীগঞ্জের কমদতলী অংশ। এর বিস্তারিত নকশা করা হয়েছে। এ অংশের সোয়ারীঘাট থেকে কদমতলী পর্যন্ত উড়াল সড়কের জন্য বিদ্যমান বাবুবাজার সেতুর পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণে এআইআইবিকে অর্থায়নের প্রস্তাব করেও সাড়া না পেয়ে জিওবিতে করার প্রস্তাব করবে সওজ। তবে সেতুর বিস্তারিত নকশা এখনও হয়নি।

নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৮৭ সালে আবদুল্লাহপুর থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত নির্মিত বিদ্যমান বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সড়ক নির্মাণ করতে চায় সওজ। ইনার সার্কুলার রুট ২২০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত হবে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের আদলে চার লেনের মূল সড়কের দুই পাশে থাকবে ধীরগতির যান চলাচলে পৃথক লেন। মূল সড়কে উভয়মুখী ৩২ ফুট প্রশস্ত ডাবল লেন রাস্তা থাকবে। মূল সড়কের দুই পাশে দেড় মিটার চওড়া শোল্ডার থাকবে। এর পর থাকবে ধীরগতির যান চলাচলে ২০ ফুট চওড়া সড়ক। সড়কের দু’পাশেই সার্ভিস লেনের পর তিন মিটার করে জায়গা খালি রাখা হবে। একপাশে ১০ মিটার জায়গা রাখা হবে ভবিষ্যতে রেলপথ নির্মাণে।

বেড়িবাঁধ নামে পরিচিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ২২০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সবচেয়ে কঠিন ধাপ, জমি অধিগ্রহণের ঝামেলা নেই। সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, সোয়ারীঘাট থেকে বাবুবাজার সেতু পর্যন্ত অংশ সরু। এরপর সদরঘাট। সদরঘাটে রাস্তা করার জায়গা নেই। সোয়ারীঘাট থেকে কদমতলী পর্যন্ত উড়াল সড়ক করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করা হবে সার্কুলার রুটকে। এ সড়ক হলে গাবতলীর গাড়ি শহরে প্রবেশ না করে পদ্মা সেতুতে যেতে পারবে।

কিন্তু কবে হবে সার্কুলার রুটের কাজ- এ প্রশ্নে স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি প্রকলপ্প পরিচালক। তবে সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পাওয়া থেকে শুরু করে দরপত্রের দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে বছর দুয়েক লাগবে। এরপর সড়ক নির্মাণে আরও কমপক্ষে দুই বছর লাগবে।

গাবতলী-কদমতলী অংশের কাজ পরিকল্পনায় ঘুরপাক খাওয়ায় ২০২০ সালের অক্টোবরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সওজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিকল্প হিসেবে মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী সেতুর কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল থেকে কলাতিয়া, হযরতপুর-রুহিতপুর সড়ককে ১৮ থেকে ২৪ ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। এ পথে গাবতলীর গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে পারবে বলে দাবি করা হচ্ছে। গত সোমবার এই সড়কে সরেজমিনে দেখা যায়, ভারী যান ও বাস চলাচলের উপযোগী নয় সড়কটি। সওজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও নাম প্রকাশ না করে একই অভিমত জানিয়েছেন।

ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে যুক্ত করতে জাইকার অর্থায়নে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কালাকান্দি, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু হয়ে মদনপুর পর্যন্ত আউটার সার্কুলার রুট নির্মাণের পরিকল্পনাও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকা বাইপাস, সাসেক-১, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ১৩০ কিলোমিটার আউটার সার্কুলার রুটের বৃত্ত পূর্ণ হবে। ৮৪ কিলোমিটার সড়ক আগে থেকে রয়েছে। বৃত্ত পূর্ণ করতে আরও ৪৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে হবে।

আরো পড়ুন : মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায় “বৈশ্বিক আলোয়” বাংলাদেশের ৭ তরুণ

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *