শুক্রবার সরজমিনে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর

অনুসন্ধানী ইতিহাস-ঐতিহ্য ওকে নিউজ স্পেশাল জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

ভেকু দিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভেঙে ফেলা বাড়ির চিত্র দেখতে গতকাল দিনভরও ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। কেউ এসেছেন বন্ধুর সঙ্গে। কেউ বাবার হাত ধরে। কেউ আবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় পরিবারের সদস্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ লোক বাড়ি ভাঙার পক্ষে কথা বললেও কেউ কেউ এই ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের বিপক্ষেও মত দিয়েছেন।

সরজমিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় গতকাল দেখা যায়, সকাল থেকেই লোক সমাগম রয়েছে এলাকাটিতে। কেউ মিরপুর থেকে এসেছেন। কেউ কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীচর, কেউ আবার এসেছেন মোহাম্মদপুর থেকে। সকলে এসে বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। স্লোগান দিচ্ছেন। পায়ে হাঁটা মানুষের ভিড়ের মধ্যে রিকশা, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল আর গাড়ির চাপে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে আবাহনী মাঠের পেছন থেকে শুরু করে ৩২ নম্বর পর্যন্ত। এত মানুষের সমাগম দেখে বিভিন্ন খাবারের দোকান সাজিয়ে নিয়েও বসেছেন অনেকে। যেন এক দর্শনীয় স্পটে রূপ নিয়েছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর। অনেকেই স্মৃতি হিসেবে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর ভাঙা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। কেউ আবার হেসকাব্লেড দিয়ে ভাঙা বাড়ির রড কাটায় ব্যস্ত। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সকালের তুলনায় গতকাল মানুষের চাপ সবচেয়ে বেশি ছিল বিকালে। অনেকের মধ্যে এমনই একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, মিরপুরে বাসা ও বৃহস্পতিবার অফিস থাকায় এখানে আসতে পারিনি। তিনি বলেন, এই ভাঙা বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। এত ক্ষমতাশালী ছিল শেখ মুজিব ও তার মেয়ে শেখ হাসিনা। কিন্তু আজ তাদের বাড়ির এই অবস্থা। তাই ৩২-এর এই ভাঙা বাড়ি থেকে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ আমাদের সকলের শিক্ষা নেয়া উচিত।

কেরানীগঞ্জ থেকে ছেলের সঙ্গে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে আসা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বলেন, আমি সেই কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছি শুধু এই বাড়িটি দেখতে। তিনি বলেন, বিশ্বের কতো বড় বড় রাজনৈতিক নেতা আছেন যারা তাদের কর্মের জন্য আজও অমর হয়ে আছেন। তাদের দেশের মানুষ তাদেরকে কতো শ্রদ্ধা করে। আবার এমন মানুষও আছে যাদের বাড়ি বুলডোজার লাগিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এগুলো সবই কর্মের ফল। যে যা করবে তাকে সেই ফল ভোগ করতে হবে। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তিনিই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিচারক।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আগুন লাগানোর পর ভাঙা বাড়ির কয়লা ও ইটের টুকরো নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, হাজার হাজার বছরের সুন্দর নগরীও এক সময় কয়লায় রূপ নেয়। কয়লা হচ্ছে প্রতিটি জিনিসের সর্বশেষ রূপ। বছরের পর বছর ধরে নানা ইতিহাস বহন করা শেখ মুজিবের এই বাড়িটিও আজ কয়লা হয়ে গেছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর নির্মাণশৈলী। এই ধ্বংসাবশেষও দু’দিন পর থাকবে না। হয় কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে, না হয় সরিয়ে ফেলা হবে। তাই এই কয়লা আর ইটের টুকরো আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে।

মোহাম্মদপুরের এক বাসিন্দা বলেন, শেখ হাসিনা যত অন্যায় করেছিল তার ফলস্বরূপ তাকে ৫ই আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তারপর কিন্তু সব ঠিকই চলছিল। হঠাৎ করে তার এমন বক্তব্য দেয়ার জন্যই আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙচুর, সুধাসদনে আগুনসহ সারা দেশে এক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। দেশটা আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে। তিনি তো ভারতে পালিয়ে গিয়ে ভালোই আছে, আমাদের দেশের মানুষ আছে অশান্তিতে। তাই আমরা চাই এই ফ্যাসিস্ট হাসিনা আর যেন দেশে না আসে।

এসব ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের বিরোধিতাও করেছে অনেকে। মধ্য বয়সী এক লোক বলেন, একজন অন্যায় করেছে বলে যদি আমরাও অন্যায় করি তাহলে তো তার মতো আমরাও সেই জালেম হয়ে গেলাম। তাই এসব ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে আমাদের ভেতরের পশুত্বটা জাগ্রত হয়। কোনো মজলুমের ওপর অন্যায় হলে আল্লাহ তার বিচার করেন। আর এই জন্যই এত ক্ষমতাশালী শেখ হাসিনাকে আজ দেশ থেকে পালাতে হয়েছে।

আরেকজন বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে বিভিন্ন উস্কানি দিচ্ছে। আর তাতে নেচে যদি আমরা সারা দেশে হামলা-ভাঙচুর চালাই তাহলে তো সে সফল। সে তো এটাই চায়- আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করি। দেশে অশান্তি বিরাজ করুক। সারাবিশ্ব দেখুক বাংলাদেশ একটি জঙ্গি রাষ্ট্র্র। দেশের সাধারণ মানুষ বলুক- আগের সরকারই ভালো ছিল। শেখ হাসিনা এটার জন্যই এসব করছে। তাই আমাদের উচিত যে যাই বলুক, কোনো দিকে কান না দেয়া। দেশের মানুষের ভরসা জয় করা। দেশটাকে শান্ত রাখা। কারণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতারা তো সব পলাতক। বাড়িতে নেই। ওই জনশূন্য বাড়ি ভেঙে আর লাভ কী। এতে প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে ধানমণ্ডি ৩২ আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আগমনকে ঘিরে সেখানে বিভিন্ন খাবারের দোকান নিয়ে বসেছে অনেকে। রেঙ-বেরঙের বেলুন বিক্রি হচ্ছে। চা, ঝালমুড়ি, চিকেন চাপ, কাবাব সবই পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। এক দোকানি বলেন, এখানে এই ভাঙা বাড়ি দেখতে অনেক মানুষ আসছে। তাই বেচাকেনাও ভালো হচ্ছে। আরেক দোকানি বলেন, অন্যখানে তিনদিনে যা বিক্রি করি তার চেয়ে বেশি এইখানে একবেলা বিক্রি করছি। একের পর এক মানুষ আসছে, দেয়ার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। সকলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এক উৎসব উৎসব আমেজ। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।

অপরদিকে গতকালও দিনভর একদল ছিন্নমূল মানুষকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ির ইট বালু ছাড়িয়ে রড কাটতে দেখা গেছে। কেউ আবার রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্ট, বিদ্যুতের খুঁটি খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ইট, কাঠ, রডসহ বিক্রি করার মতো কিছু পেলেই নিয়ে যাচ্ছে তারা। এমন কী শেখ মুজিবের বাড়ির পাশের সাধারণ মানুষের ভবনে ঢুকেও সব নিয়ে যাচ্ছে তারা। এসব দেখে কেউ কেউ বাধা দিলেও বেশির ভাগ মানুষ নিশ্চুপ। অনেকেই বলছে- এই বাড়ি ভাঙার মাহাত্ম্যটাই শেষ করে দিচ্ছে এসব টোকাই। এলাকাটিতে পুলিশ সদস্যদের দেখা গেলেও তারা ছিলেন নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল।

আরো : দেশটা আসলে যাচ্ছে কোথায়?

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *