স্ত্রী’র সহযোগীতায় আসাদুল্লাহকে মাদকাশক্ত বানান গাইডেন্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ পুরুষ অধিকার প্রচ্ছদ স্বাস্থ্য কথা

রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা এম এম আসাদুল্লাহর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী খাদিজা আক্তারের পারিবারিক কলহ চলছিল। কলহের জেরে একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন খাদিজা। আসাদুল্লাহকে ধরে নিয়ে যেতে ওই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আটজনকে বাসায় পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে ছয় ব্যক্তি ফ্ল্যাটে ঢুকে ঘুমন্ত আসাদুল্লাহর হাত ও মুখ বাঁধেন। এরপরে আসাদুল্লাহকে টেনেহিঁচড়ে বাসার নিচে নামিয়ে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। আসাদুল্লাহর খোঁজ না পেয়ে পুলিশের কাছে যান তাঁর বোন জান্নাতুল নাঈম। এ ঘটনার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর আসাদুল্লাহকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করা হয়।

২০২১ সালের ৭ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর রূপনগর এলাকার বাসা থেকে আসাদুল্লাহকে তুলে নিয়ে যান খিলক্ষেতের গাইডেন্স নামের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন। এ ঘটনায় ওই বছর নভেম্বরে আদালতে মামলা করেন আসাদুল্লাহ। মামলায় খাদিজা আক্তার, গাইডেন্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুজ্জামান জলিলসহ চারজনকে আসামি করা হয়। এই মামলার তদন্ত শেষে গত আগস্টে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে। ঘটনার সময় আসাদুল্লাহ ও খাদিজা আক্তার স্বামী-স্ত্রী থাকলেও ঘটনার পরে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

পিবিআই জানায়, ঘটনার সময় বৈধ অভিভাবক হিসেবে স্ত্রী খাদিজা আক্তারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গাইডেন্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আসাদুল্লাহকে নিয়ে যায়। তবে আসাদুল্লাহকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করেনি পিবিআই। যদিও আসাদুল্লাহর দুই হাত ও মুখ বেঁধে, টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ওই বাড়ির ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এ ছাড়া ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও আছেন। তবে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াসির আরাফাত বলেন, সাধারণত মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন জোর করে রোগীকে নিয়ে যান। এখানেও এমনটা ঘটেছে। মামলায় যে ধারায় অভিযোগ করেছেন বাদী, সেসব ধারায় অপরাধ হয়েছে কি না-সেটি আদালত জানতে চেয়েছেন।

অভিযোগে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া এবং অপহরণের অভিযোগ আনা হয়। বাদীর উল্লেখ করা এসব অপরাধ প্রমাণিত হয়নি বলে কাউকে আসামি করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। কাউকে অভিযুক্ত করা না হলেও যা যা ঘটেছে, তার সব বর্ণনাই তিনি প্রতিবেদনে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।

আসাদুল্লাহ যা বলেছেন: আসাদুল্লাহর অভিযোগ, ঘটনার দিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে নিজের রূপনগরের বাসায় তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ কয়েক ব্যক্তিকে দেখতে পান তিনি। ওই ব্যক্তিরা খাদিজা আক্তারের সহযোগিতায় দড়ি দিয়ে তাঁর দুই হাত পেছনের দিকে নিয়ে বেঁধে ফেলেন। তিনি কিছু বলতে চাইলে তাঁর মুখে কাগজ গুঁজে দেওয়া হয়। এরপর ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাঁকে গ্যারেজে নিয়ে যান তাঁরা। পরে কালো রঙের মাইক্রোবাসে তোলা হয় তাঁকে। চিৎকার করলে তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে মাইক্রোবাসে জ্ঞান হারান তিনি। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটি কক্ষে আটক অবস্থায় দেখতে পান। তখন ওই ব্যক্তিরা বলেন, যেকোনো মূল্যে আসাদুল্লাহকে মাদকাসক্ত হিসেবে আটক করে রাখতে হবে। তাঁর কাছ থেকে সম্পত্তি লিখে নিতে হবে। তাঁকে একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়।

আসাদুল্লাহ বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন, পাগল ও মাদকাসক্ত রোগী সাজিয়ে চার মাস তাঁকে আটকে রাখার কথাও জানিয়েছিলেন অপহরণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়ার পর জোর করে তাঁকে চেতনানাশক ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে তাঁর বোন পুলিশ নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন।

আসাদুল্লাহ ও খাদিজা রূপনগরের যে বাড়িতে থাকতেন, ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন জাফর আলী। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ভোরে কয়েকজন ব্যক্তি একটি মাইক্রোবাস নিয়ে বাসার সামনে আসেন। তাঁরা বাড়ির মূল ফটক খুলতে বলেন। খুলতে রাজি না হওয়ায় খাদিজা আক্তার নিচে নেমে আসেন। সেসব ব্যক্তির মধ্যে দুজন ছাড়া সবাই ওপরে ওঠেন। এর কিছুক্ষণ পর আসাদুল্লাকে বেঁধে বাড়ির নিচে নিয়ে আসেন তাঁরা। এরপর মাইক্রোবাসে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়।
রূপনগর থানার এক কর্মকর্তা জানান, আসাদুল্লাহ ও খাদিজার এক কন্যাসন্তান রয়েছে।

ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে খাদিজা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পিবিআই তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চান না। এ বিষয়ে কোনো কিছু জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেন তিনি।

পিবিআইয়ের তদন্ত: আদালতে দেওয়া পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহের জেরে খাদিজা আক্তার পরিবারের কাউকে না জানিয়ে স্বামী আসাদুল্লাহকে গাইডেন্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেন। ঘটনার দিন ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আসাদুল্লাহ ওই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ছিলেন। গাইডেন্সের তিন কর্মী শফিকুল ইসলাম ওরফে টিপু, আশরাফুজ্জামান জলিল ও এস এম নায়েবুল ইসলাম ওরফে সাদ ‘সরল বিশ্বাসে’ আসাদুল্লাহকে তাঁর ফ্ল্যাট থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেন। অন্য সাক্ষীদের কারণে আসাদুল্লাহর মাদক গ্রহণ-সংক্রান্ত পরীক্ষা ছাড়াই গাইডেন্স তাঁকে বোনের জিম্মায় ছেড়ে দেয়।

এদিকে ‘সরল বিশ্বাসে’ আসাদুল্লাহকে নিয়ে যাওয়ার তথ্য পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এলেও হাত ও মুখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রতিবেদনে নেই। সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও দেখা গেছে, আসাদুল্লাহকে ধরে নিয়ে যেতে সেদিন আটজন রূপনগরের বাসায় এসেছিলেন। এর মধ্যে দুজন নিচে অবস্থান করছিলেন এবং ছয়জন বাড়ির ওপরে গিয়ে আসাদুল্লার হাত ও মুখ বেঁধে নিয়ে যান।

মামলায় আসাদুল্লাহ অভিযোগ করেন, ফ্ল্যাট লিখে নিতে খাদিজা আক্তার তাঁকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন দিয়ে অপহরণ করান। পিবিআই তদন্ত করে এই দুটি অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত বলেন, সেদিন যা যা ঘটেছে সবই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত যে দুটি অভিযোগের তদন্ত করতে বলেছেন, সেই দুটি অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

পিবিআই প্রতিবেদনে বলেছে, আসাদুল্লাহ ও খাদিজা ২০০৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের ১২ বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বিয়ের কিছুদিন পরই তাঁদের মধ্যে কলহ শুরু হয়। কলহ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে ২০১১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। একমাত্র কন্যাসন্তানের কথা ভেবে তাঁরা ২০১৪ সালে আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু তাঁদের পারিবারিক কলহের অবসান হয়নি। সমঝোতার জন্য বিভিন্ন সময় তাঁদের মধ্যে সালিসও হয়। তবুও তাঁদের মধ্যে কলহ বেড়েই চলছিল। গত বছরের ৪ অক্টোবর রূপনগর থানায় একটি সমঝোতা বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, তাঁদের মেয়ের পরীক্ষা থাকায় তাঁরা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবেন। যদি তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন না হয়, তাহলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একে অপরকে তালাক দেবেন। সমঝোতার তিন দিন পরই আসাদুল্লাহকে জোর করে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

পুলিশ ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছালে প্রতিশোধ নিতে আসাদুল্লাহকে তাঁর স্ত্রী খাদিজা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পাঠান। সেখান থেকে ফিরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে আসাদুল্লাহ মাদকাসক্ত কি না, তাঁর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করেন। সেই প্রতিবেদনেও তাঁর মাদকাসক্তির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনেও ওই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র যা বলছে: গাইডেন্স মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুজ্জামান বলেন, আসাদুল্লাহর বোন আসার পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটি অপহরণ কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে একজন পুলিশ সদস্যও এসেছিলেন। কোনো রোগীকে উদ্ধার করে আনার জন্য জোর করতে হয়। কোনো রোগী তো স্বেচ্ছায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আসেন না।

রোগীকে বেঁধে আনার সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে আশরাফুজ্জামান বলেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে রোগীকে এভাবে আনা হয়। কারণ, যাঁরা উদ্ধার করতে যান, তাঁদের ওপর রোগী আক্রমণ করেন। রোগীর আক্রমণে অনেকের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাই সবাই এভাবেই রোগীদের উদ্ধার করে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। রোগীকে নিরাময় কেন্দ্রে আনার সাত দিনের মধ্যে মাদকাসক্তি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় মাদকাসক্তির প্রমাণ পাওয়া না গেলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা দক্ষিণ অঞ্চলের উপপরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, এভাবে কাউকে বেঁধে নেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বৈধ অভিভাবক আবেদন করলে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন গিয়ে রোগী নিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে রোগী ও পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে তাঁদের নিয়ে আসা হয়। তবে বেঁধে আনার কোনো সুযোগ নেই।

আসাদুল্লাহ বলেন, পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে নারাজি দিয়ে তিনি আদালতে পুনঃতদন্ত চেয়ে আবেদন করেন। তাঁর সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে, তাতে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি চান তিনি।

আরো পড়ুন : গোমস্তাপুরে সড়ক র্দুঘটনায় আহত ৩

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *