স্টাফ রিপোর্টার, পাাবনা থেকে : পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ’ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছে অডিট বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প ও একাডেমিক খাতে নানা অনিয়মের কারণে এ অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তর বিভাগের ২০২২-২৩ নিরীক্ষা বছরের অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাকিলা জামানের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি নিরীক্ষক টিম সম্প্রতি এই অডিট সম্পন্ন করে শত কোটি টাকার অনিয়ম তুলে ধরে রিপোর্ট দাখিল করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টির চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। বাজেটের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ভাতা প্রদান, প্রাপ্যতা ছাড়া ভাতা প্রদান, ইউজিসি’র অনুমোদন ছাড়া বিধি বহির্ভূত চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করা, প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে আয়কর ও ভ্যাট কর্তন না করা, আর্থিক বিধি লঙ্ঘন করে ফিলিং স্টেশনকে প্রাপ্যতাবিহীন সুবিধা প্রদান, প্রকল্পের জামানত হতে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়া, ডিপিপি লঙ্ঘন করে আসবাবপত্র ক্রয়, প্রচার ও বিজ্ঞাপনের বিলে সারচার্জ কর্তন না করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে ডিনের দায়িত্ব প্রদান, চুক্তিমূল্যের অতিরিক্ত অর্থ ঠিকাদারকে প্রদান, ডিপিপিতে নির্ধারিত কাজ বাস্তবায়ন না করা, পদ ছাড়াই অর্গানোগ্রাম বহিভূতভাবে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান, বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত আয় বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে প্রদর্শন না করা, নিম্নমানের বই সরবরাহ প্রভৃতি খাতে শত কোটি টাকার অধিক আর্থিক অনিয়ম হয়েছে মর্মে অডিট রিপোর্টে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। শুরু থেকেই এই প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ লোপাটের কথা শোনা গেলেও এবার শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। অনিয়মের খাতগুলোতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত নিজস্ব আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে প্রদর্শন না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। অর্গানোগ্রামে পদ ছাড়াই উপ-রেজিস্ট্রার, উপ-গ্রন্থাগারিক, উপ-পরিচালক ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে বিধি বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ৪ কর্মকর্তাকে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৯ লাখ ৮২ হাজার ৭শ’ টাকা।
প্রিয়াংকা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন এবং ইঞ্জিনিয়ার্স কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামক দুটি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিমূল্যের অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪১ লাখ ২৬ হাজার টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে ডিন নিয়োগ দিয়ে ভাতা প্রদান করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ডিপিপিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আসবাবপত্র ক্রয় করার কথা থাকলেও সরাসরি আর্থিক ক্ষমতা বহিভূতভাবে ক্রয় করায় এতে অনিয়ম হয়েছে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার ১৩৩ টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের জামানত থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না করে সম্মানি, টিএ, ডিএ ও আপ্যায়নের নামে খরচ করা হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭৮ টাকা। কোনোরূপ আর্থিক বিধি-বিধান ছাড়াই জ্বালানি সরবরাহকারী ফিলিং স্টেশনকে অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে, এতে অনিয়ম হয়েছে ৩৭ লাখ টাকার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল থেকে নির্ধারিত হারে আয়কর কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ২ কোটি ৪২ লাখ ৩৮৪ টাকা। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ইঞ্জিনিয়ার্স কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করায় সরকারের ক্ষতি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা।
বিশ্বিবিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়িমিতভাবে ব্যয় করায় আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ ৬৭ হাজার ৫৭ টাকা। ডিপিপিতে নির্ধারিত থাকলেও ৩ তলা শিক্ষক-কর্মকর্তা ক্লাবের পরিবর্তে ২ তলা, ৪ তলা ভিতবিশিষ্ট ২ তলা আনসার ক্যাম্পের পরিবর্তে ১ তলা এবং ওয়াটার বডি ও কেন্দ্রীয় পানি নিষ্কাশন লাইন নির্মাণ না করে নয়-ছয় করা হয়েছে ৯ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বিভাগে ১২ কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৭ টাকার বই কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিরীক্ষা দল সরজমিন পরিদর্শনে দেখতে পায় ঠিকাদারের সরবরাহকৃত অধিকাংশ বই নিম্নমানের কাগজে ফটোকপি করা। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপত্তি গ্রহণ করলেও কোনো জবাব প্রদান করেনি। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে বলে অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গেছে।
পাবনা নাগরিক সমাজের সভাপতি আব্দুল মতীন খান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগামহীন দুর্নীতি চলছে। দেখার কেউ নেই। এবারই প্রথম অডিট রিপোর্টে কিছুটা এসেছে।
এ ব্যাপারে পাবিপ্রবি’র ট্রেজারার ড. একেএম সালাাহ উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইলে, ওয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো উত্তর তিনি দেন নাই।
অনিয়ম সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জি এম আজিজুর রহমান জানান, অডিট আপত্তি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটি সাংবাদিকদের জানার কথা না। যারা অডিট করেছে তারা আমাদের জানিয়েছেন। আমরা ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করছি। এরপরেও যদি কোনো বিষয় থাকে তবে সরকারের টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। এ নিয়ে তুলকালামের কিছু নেই।
পাবিপ্রবি’র উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘বিষয়টি আমি যোগদানের আগের ঘটনা। আমার সময় কোনো অনিয়ম বা অডিট আপত্তি হয়নি। আপনারা জানেন যারা অডিট করতে আসে তারা সব সময় কিছু না কিছু আপত্তি তুলে ধরে পরামর্শ দেয়। আমরা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তীতে কাজ করার চেষ্টা করবো।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত পাবনা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খায়রুল হক বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়টি দুদক খতিয়ে দেখবে। কোনো দুর্নীতি পাওয়া গেলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরো পড়ুন : ডেঙ্গু রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না ঢামেকের মেঝেতেও