সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। টেন্ডারের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রস্তাবনার গরমিল হওয়ায় এক বছরে সরকারের দেড়শ’ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পের জন্য আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দরপত্রের ফল প্রকাশ হয় ৭ মাস পর। তার ২ মাস পর চাওয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রস্তাবনা-আরএফপি। দরপত্রের সঙ্গে আরএফপি’র শর্তের আকাশ-পাতাল অমিল দেখা যাওয়ায় দরপত্রে অংশ নেয়া আগ্রহীদের মধ্যে নানা সন্দেহ তৈরি হয়। প্রথম শর্তে ৫ জন কর্মকর্তার স্বাক্ষরে বাস্তবায়ন খরচ, কাজের পদ্ধতি, বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়সহ প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রকাশিত সংশোধিত শর্তে প্রথম শর্ত তৈরির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারোরই স্বাক্ষর নেই। এমনকি সংশ্লিষ্টরা শর্ত পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম শর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকল্প থেকে প্রথম এক বছর মাসিক কোনো বিল পরিশোধ করতে হবে না বলে উল্লেখ ছিল। অথচ সংশোধিত শর্ত অনুযায়ী সংযোগের পর থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প থেকে ইন্টারনেট চার্জ দিতে বলা হয়েছে।
যেখানে মাসে লাগবে ১ হাজার ২০০ টাকা করে। সে হিসেবে সারা দেশের প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারকে ১ বছরে গচ্চা দিতে হবে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। প্রথম শর্তে রাউটারের প্রয়োজনীয় স্পেসিফিকেশন ৭টি থাকলেও সংশোধিত শর্তে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৪টি। অভিযোগ উঠেছে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এসব করা হয়।
প্রকল্পের দরপত্র, প্রথম শর্ত ও সংশোধিত শর্তে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ইডিসি প্রকল্পের সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগের টেন্ডারে নানা রকম দুর্নীতি হচ্ছে এরকম অনেক ভুক্তভোগী মৌখিক অভিযোগ করেছেন। ২০২২ সালের আগস্টে সারা দেশের স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৮টি প্যাকেজে মোট ৩৭টি লটে ১০৯২৪৪টি সংযোগ স্থাপনের টেন্ডার প্রকাশিত হয়। অভিযোগকারীরা জানান, টেন্ডারটি প্রকাশের পর প্রায় ৭ মাস পর ইওআই (আগ্রহ ব্যক্তকরণ) এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এরমধ্যে ইডিসি প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর কষাকষি করেন বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেন। তারা জানান, এ বিষয়ে ইডিসি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর অভিযোগ করে কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে তারা দাবি করেন যে ২০২২ সালে প্রকাশিত টেন্ডারের সঙ্গে প্রকাশিত টার্মস অব রেফারেন্সের সঙ্গে আইএফপিতে দেয়া টার্মস অব রেফারেন্সের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। প্রতিবেদকের কাছে ইতিমধ্যে টেন্ডারের সঙ্গে প্রথমে প্রকাশিত এবং আরএফপি’র সঙ্গে দেয়া টার্মস অব রেফারেন্স সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট এসেছে। দুটি টার্মস অব রেফারেন্স বিশ্লেষণ করে দেখা যায় দু’টির মধ্য বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে।
দুটি টার্মস অব রেফারেন্সের নিচে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটিতে ৫ জন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেছেন কিন্তু চূড়ান্তটিতে তাদের স্বাক্ষর নেই। প্রথম টার্মস অব রেফারেন্সে স্বাক্ষর করেছেন এরকম ৪ জন কর্মকর্তাকে না জানিয়ে গোপনে আরেকটি কমিটি করে ২য় শর্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। যারা প্রথমটিতে স্বাক্ষর করছে তারা ২য় শর্তে কেন স্বাক্ষর করেননি? এই কর্মকর্তাগণ কারা এবং কেন তারা স্বাক্ষর করেননি? এটা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। জানা গেছে, তাদেরকে না জানিয়ে আরেকটি কমিটি করে ২য় টি করা হয়েছে। ১ম শর্তে এক বছরের ইন্টারনেট সার্ভিসসহ সংযোগ দিতে বলা হয়েছিল প্রকল্পকে। ২য় টিতে সংযোগের পর থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মাসিক ইন্টারনেট চার্জ দিতে বলা হয়েছে। প্রতিটি সংযোগের জন্য প্রকল্পের ডিপিপিতে ৩৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। যার মোট ব্যয় ৩৮২ কোটি টাকা। এতে করে প্রকল্পের ব্যয় না বাড়লেও প্রতিটি সংযোগের জন্য সরকারের বছরে ১ হাজার ২শ’ টাকা করে ১ লাখ ৯ হাজার ২৪৪টি সংযোগের জন্য ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। ১ম শর্তে একটি ওয়াইফাই রাউটারের কনফিগারেশন দেয়া আছে ৭টি। সংশোধিত দ্বিতীয় শর্তে সেটা বেড়ে হয়েছে ৪৪টি। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, কোনো নির্দিষ্ট ব্রান্ডের কোম্পানির রাউটার কিনতে বাধ্য করার জন্য এমনটা করা হয়েছে। ১ম শর্ত ব্যবহারকারী এবং প্রকল্প উভয়ের কাছ থেকে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত গ্রহণযোগ্যতার সনদ নিতে হবে এমনটি বলা হয়। কিন্তু সংশোধিত দ্বিতীয় শর্তে শুধু ব্যবহারকারীর কাছ থেকে সনদ নিলে হবে বলে বলা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে এই দুর্নীতির সঙ্গে প্রধান সমন্বয়কারী প্রকল্পের এপিডি প্রোগ্রামার পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা জড়িত। তাকে এ কাজে সহায়তা করছেন ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এক নেতা যিনি মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন।
ইডিসি প্রকল্পের প্রথম ও সংশোধিত শর্তপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইন্টারনেট সেবার চার্জ হিসেবে প্রথম শর্তে বিনামূল্যে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত শর্তে প্রতি মাসে ১ হাজার ২শ’ টাকা করে দিতে বলা হয়। প্রত্যায়ন সনদের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তে ব্যবহারকারী ও প্রকল্প কর্মকর্তার কথা বলা হলেও সংশোধিত শর্তে শুধু ব্যবহারকারীর সনদের কথা বলা হয়েছে। কাজের বিল আদায়ের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তে ব্যবহারে সন্তোষজনক সনদের পর বলা হলেও সংশোধিত শর্তে বলা হয়, সংযোগে ২০ শতাংশ ও ব্যবহার শুরুর পর ৮০ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাউটারের স্পেসিফিকেশন মাত্রাটি পরিবর্তনের সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট যদি না থাকে তাহলে সেটা একটি অনিয়ম। এখানে ক্রয়পত্রে সরকারের যে ক্রয়নীতি আছে সেটা অনুসরণ করা হয়েছে কিনা এসব বিষয়গুলো পরখ করে দেখা প্রয়োজন।
ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন ইডিসি প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) প্রণব কুমার সাহা বলেন, যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে তা কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নয়; এবং এটি মিথ্যা। যারা এসব তথ্য ছড়াচ্ছে তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর করছি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ধরনের তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য কিছু চক্র কাজ করছে। যারা এসব করছে তারা দেশের ভালো চায় না। দেশের উন্নয়ন চায় না।
আরো পড়ুন : ডেঙ্গুর রুগীর জন্য প্রয়োজনীয় প্লাটিলেট কিটের সংকট দেখা দিয়েছে