ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাস নির্মাণে মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ার কারণে ৩ বছরের প্রকল্প ১৭ বছরে
চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। দেশটির মূল্যস্ফীতি আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২ শতাংশে পৌঁছেছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানের মুদ্রার মান ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণে নির্মাণ সামগ্রীসহ সব ধরনের পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাস নির্মাণে। আর এই কারণে দূতাবাস নির্মাণ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ইসলামাবাদস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি। যদিও এর আগে কয়েক দফায় ব্যয় এবং মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। দফায় দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ার কারণে ৩ বছরের প্রকল্প গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১৭ বছরে। ব্যয় বাড়ছে তিনগুণ। আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি উঠছে বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানের ইসলামাবাদে দূতাবাস নির্মাণে ২০০৭ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প নেয়া হয়।
‘পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল একই বছরের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত। বারবার সংশোধনের ফলে এই প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। শুরুতে প্রকল্পটির মেয়াদ ৩ বছর রাখা হলেও সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে বারবার সময় বাড়ানোয় এরই মধ্যে কেটে গেছে ১৬ বছর। তারপরও শেষ হয়নি। সংশোধনীতেই আটকে আছে প্রকল্পটি। এখন আবার নতুন করে ব্যয় এবং মেয়াদ বাড়িয়ে চতুর্থ সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের দেয়া চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির মানের অবনমন ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে বিগত ২-৩ বছর ধরে নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের পাকিস্তানের পিডব্লিউডি’র রেট শিডিউল অনুসারে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া পূর্বের ডিজাইনের সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে মূল্য সমন্বয় ও নতুন কাজের জন্য অতিরিক্ত ১৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা প্রয়োজন এবং অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৪ পর্যন্ত অর্থাৎ নতুন ২ বছর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। চতুর্থ সংশধোনীর বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের মতামত হলো- প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের নির্মাণাধীন চ্যান্সারি কমপ্লোক্সের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে নিজস্ব ভবনে মিশনের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে বিধায় প্রকল্পটির ৪র্থ সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন বিবেচনাযোগ্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে ৯৭ কোটি ৪২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০০৭ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ একনেকে উঠছে ১০ প্রকল্প: এদিকে আজ একনেকে অনুমোদনের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের ১০টি প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১১ই এপ্রিল রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হবে। আজকের একনেক সভায় যেসব প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে তার মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের দুইটি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পটিও আজ একনেক বৈঠকে উঠছে। প্রকল্পটি মোট ৬৯৯ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এপ্রিল ২০২৩ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো- ৮০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোর উন্নয়ন করা, হাওর এলাকায় ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ডুবন্ত বাঁধ সিসি ব্লক দিয়ে আবৃত করে ডুবন্ত বাঁধের টেকসই উন্নয়ন করা, ৪ কিলোমিটার নদী তীর রক্ষা কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর তীর এবং সংলগ্ন মূল্যবান জমি ও সম্পত্তি রক্ষাকরণ এবং সমন্বিত কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত বন্যা ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করা।
আজ স্থানীয় সরকার বিভাগের এডিবি’র জরুরি সহায়তায় বন্যা ২০২২-এ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অবকাঠামো পুনর্বাসন প্রকল্পটিও একনেকে উঠছে। বাংলাদেশ সরকার ও এডিবি’র যৌথ অর্থায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কর্তৃক প্রস্তাবিত এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি পহেলা এপ্রিল ২০২৩ হতে ৩০শে জুন ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘সিলেট-চারখাই-শেওলা মহাসড়ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটিও আজকের একনেক সভায় উঠছে। প্রকল্পটি ৪ হাজার ২৫৭ কোটি ৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে পহেলা জানুয়ারি ২০২৩ হতে ৩১শে ডিসেম্বর ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ‘২০২২ সালের বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের সিলেট-ছাতকবাজার সেকশন (মিটারগেজ) পুনর্বাসন” শীর্ষক বিনিয়োগ প্রকল্পটি মোট দুইশত একচল্লিশ কোটি ষাট লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এপ্রিল ২০২৩ হতে মার্চ ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একনেকে উঠছে। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জব্স’ শীর্ষক প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় আবরো বাড়ছে। প্রকল্প সংশোধনের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক টেন্ডার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার পর অনুমোদিত প্রকল্পের সংস্থান অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন, বিদ্যমান বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় পরিবর্তন, অঙ্গ অন্তর্ভুক্তি ও বাদ, আগের তুলনায় বেশি জমি অধিগ্রহণ করতে ৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা লাগছে এবং ১টি টেকনোলজি সেন্টারের স্থান পরিবর্তনের কারণে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘সার সংরক্ষণ ও বিতরণ সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটিরও মেয়াদ ও ব্যয় আবারো বাড়ছে। জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব এবং অনেক ক্ষেত্রে জমির মূল্য বৃদ্ধি, প্রকল্পের পূর্ত কাজের ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্তির কারণে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)।
ওদিকে মঙ্গলবার একনেকে উঠছে এমন আরও প্রকল্প হলো- কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আওতায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বাংলাদেশ ভূমি জরিপ শিক্ষার উন্নয়ন (১ম সংশোধিত)’ শীর্ষক বিনিয়োগ প্রকল্প, স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণে জরুরি সহায়তা প্রকল্প এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘সার সংরক্ষণ ও বিতরণ সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ (১ম সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্প।