নিজস্ব প্রতিবেদক : বিদেশে বাড়ি ও সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে উৎসব চলছে বাংলাদেশিদের। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের পর দুবাই ও লন্ডনে হিড়িক পড়েছে সম্পদ কেনার। আগেই আগ্রহের স্থান ছিল সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। এখন সম্পদ কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে বাংলাদেশিরা এখন সম্পদ কেনায় ধনী দেশের নাগরিকদের দখল করে নিচ্ছেন টপকিয়ে শীর্ষস্থানগুলো। ইতোমধ্যেই দুবাইয়ে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা সারা বিশ্বে রয়েছেন এক নম্বরে। আবার লন্ডনের অভিজাত স্থানে সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রেও শীর্ষ দশে আছেন বাংলাদেশিরা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব সম্পদ কিনতে যেসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা বৈধ বা অবৈধ যে উপায়েই আয় করা হোক দেশের বাইরে তা নেওয়া হয়েছে অবৈধ উপায়ে। কারণ বাংলাদেশ থেকে অর্থ স্থানান্তরের এগুলোর কোনো ক্ষেত্রেই অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
জানা যায়, বিশ্বের ধনীদের দ্বিতীয় ঘর হয়ে উঠছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। এর মধ্যেই দুবাইয়ে বাড়ি কেনায় বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা। করোনা মহামারির একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের মানুষ জমি-বাড়ি কিনছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সবার আগে। দুবাইয়ের সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, (২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত) বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ১২ কোটি ২৩ লাখ দিরহাম বা ৩৪৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাড়ি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, (দুবাইয়ে বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার এই তালিকায় আছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলারা।) দুবাইয়ের এসব বিনিয়োগের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে ১ কোটি দিরহাম বা ২৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলে গোল্ডেন ভিসা দেওয়া হয়। বিদেশিদের বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধও শিথিল করা হচ্ছে। লেনদেনের ৭০ শতাংশ হচ্ছে নগদ অর্থে। পৃথিবীর সব দেশের ক্ষমতা ও সামর্থ্যবানেরা সেখানে বাড়ি কিনছেন। রাশিয়ার তেল ব্যবসায়ীরা পশ্চিমা দেশগুলোতে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে যেমন দুবাইয়ে বাড়ি কিনছেন, তেমনি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফুলেফেঁপে ওঠা পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোর ব্যবসায়ীরাও পাড়ি জমাচ্ছেন সেখানে। হলিউড বলিউড ও ফুটবল বিশ্বের বিলিয়নিয়ার তারকারাও কিনছেন দুবাইয়ে বাড়ি ও ফ্ল্যাট। কিন্তু এসবের মধ্যেই বাংলাদেশিরা তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছেন।
লন্ডনের সবেচেয়ে অভিজাত এলাকায় প্রপার্টি কেনা শীর্ষ দশে বাংলাদেশিরা : লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলো স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডন’ হিসেবে। গোটা লন্ডনে এসব এলাকায় প্রপার্টির দাম সবচেয়ে বেশি। লন্ডনভিত্তিক অভিবাসনসংক্রান্ত সেবা অ্যাস্টনসের তথ্যানুসারে, (২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের তালিকায় বাংলাদেশিরা আছেন শীর্ষ দশে। ব্রিটিশ রিয়েল এস্টেট ও প্রপার্টি ব্যবস্থাপনা সংস্থা নাইট ফ্রাঙ্ক ও যুক্তরাজ্য সরকারের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা এ তালিকায় দেখা যায়, (২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের তালিকায় বাংলাদেশিদের অবস্থান ছিল নবম। ওই নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশিরা।) বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এসব লেনদেনে গড় ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ লাখ পাউন্ড (প্রায় ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা)। তালিকায় অফশোর প্রপার্টি হিসেবে বেনামে নিবন্ধিত সম্পত্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের ঠিকানায় নিবন্ধনকৃত প্রপার্টিও রয়েছে অনেক। ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারিতেও যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তি মালিকের বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ছয় বছরের মাথায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২- তে। এর পাঁচ বছর পর ২০২১ সালের আগস্টে এ সংখ্যা দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশিতে মোট ১০৭। যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের মতে, লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় অন্তত অর্ধশত (বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের) বাড়ি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। সাধারণত ‘টিয়ার-১ ইনভেস্টর’ শ্রেণিতে ২০ লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করলেই যুক্তরাজ্যে পাঁচ বছর থাকার অনুমতি পেতেন বিদেশিরা। এরপর তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসেরও আবেদন করতে পারতেন। দুই বা তিন বছরের মধ্যেই স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে হলে বিনিয়োগ করতে হতো যথাক্রমে ১ কোটি ও ৫০ লাখ পাউন্ড। তবে গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। যদিও ইনোভেটর ভিসা ও স্কেল-আপ ভিসা ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগভিত্তিক অভিবাসনের সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। এ ধরনের ক্যাটাগরিতে যুক্তরাজ্যে যাওয়া ব্যক্তিরাই প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের অভিজাত এলাকাগুলোয় প্রপার্টির বড় ক্রেতা। আর শিক্ষাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হওয়া সাধারণ বাংলাদেশিদের চিত্র তাদের তুলনায় পুরোটাই ভিন্ন। জানা যায়, যুক্তরাজ্যে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার আইন খুবই কঠোর। এ দেশে একটি ব্যাংক হিসাব চালু করতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু কীভাবে বাংলাদেশিরা যুক্তরাজ্যে সম্পদ এনে বাড়ি বা সম্পত্তি কিনছেন সেটিও একটি বিস্ময়। এখানেও কিছু মধ্যস্থতাকারী বা দালাল আছে, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ পাচারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তবে অনেক প্রবাসী স্থায়ী বাসিন্দার বাড়ি কিনছেন।
কানাডায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের এক-তৃতীয়াংশই গিয়েছে গত এক দশকে : কানাডায় সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুসারে, এ মুহূর্তে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে ৭০ হাজার ৯০ জন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি গিয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। কানাডা সরকার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ এক দশকে গিয়েছে ২৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশি। তার মধ্যে ২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গিয়েছে ১২ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশি। (১৩ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশি গিয়েছে ২০১৬-২১ সালের মধ্যে।) সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের কারণে বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পছন্দের গন্তব্যের তালিকায় কানাডার অবস্থান এখন শীর্ষে। বিভিন্ন পেশাজীবী অভিবাসনের সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে। কিন্তু দেশটিতে আইনের নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে অর্থ ও সম্পদ পাচার করে বিনিয়োগকারী কোটায় অভিবাসনের সুযোগও নিয়েছেন অনেকে। তবে কানাডা সরকার এখন বিদেশিদের কাছে বাড়ি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তাদের দেশের নাগরিকরা বিদেশিদের কারণে বাড়ি কিনতে বিড়ম্বনায় পড়ছে এবং বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্লট ও ফ্ল্যাট কেনায় প্রবাসী ও দেশীয়দের আরও বিনিয়োগে ছাড় দিলে বাইরে কেনার প্রবণতা কমবে। এতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে এবং ডলার আসবে অধিক হারে।
সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন
আরো পড়ুন : বাংলাদেশে নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা ক্যাথরিন কুক