এবার কোরবানির ঈদেও খামারিদের হাল হতে পারে ‘ঘরপোড়া গরু’র মতো !

ওকে নিউজ স্পেশাল কৃষি জাতীয় প্রচ্ছদ হ্যালোআড্ডা

এবার নেই করোনা। তবে মানুষের মনে আছে সব পণ্যের আগুনদামের বেদনা। তার পরও  ঘিরে প্রস্তুত পশুর খামার। গত দুই বছরের হাটের তেতো স্মৃতি খামারিরা ভুলতে চাইবেন এবার। তবে গ্রামগঞ্জের খামারের সবশেষ খবর তেমন একটা ভালো নয়। প্রাণিখাদ্যের দামের উত্তাপে পুড়ছেন খামারিরা। মিলছে না এই বাড়তি দামের যোগ-বিয়োগ। গত দুই বছরের মতো এবারও খামারিদের হাল ‘ঘরপোড়া গরু’র মতো। তাই তাঁরা দেখছেন ‘সিঁদুরে মেঘ’। কোনো কোনো উদ্যোক্তা এরই মধ্যে খুলেছেন লাভের বদলে লোকসানের খাতা। টিকতে না পেরে অনেক খামারি আগেভাগেই পশু বিক্রি করে দেওয়ার পথে হাঁটছেন।

এ খাতের সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, সব জিনিসের দাম দলবেঁধে বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। ফলে এবার পশু বিক্রিও কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

গোখাদ্যের দাম ও পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে এবার কোরবানির হাটে গরুসহ অন্যান্য পশুর দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বাজার-বিশ্নেষকরা। এরই মধ্যে বাজারে গরুর দাম ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবুও সন্তুষ্ট নন খামারিরা। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বন্ধ, পরিবহন নির্বিঘ্ন করা এবং পশুবাহী গাড়ি টোলমুক্ত করা গেলে তাঁরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।

দেশে গরুর চেয়ে ছাগল বেশি: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আশা, কোরবানির জন্য এবারও গবাদিপশুর সংকট হবে না।

দেশি গরুতেই মিটবে চাহিদা। অধিদপ্তর বলছে, গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে দেশে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি গরু ও মহিষ এবং ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭টি ছাগল ও ভেড়া বাজারে বিক্রির জন্য উঠতে পারে।

গত বছর কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পশু কোরবানি হয় গত বছর। তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। তার পর থেকে ক্রমাগত বেড়ে ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ, ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ও ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ওই বছর ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি পশু কোরবানি হয়। গত দুই বছর করোনা ও বন্যার কারণে চাহিদা কম ছিল বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

বাজারে পড়তে পারে গোখাদ্যের আগুনদামের প্রভাব: খামারিরা জানিয়েছেন, প্রান্তিক চাষিরা গরুকে খাবার হিসেবে দেন তৈরি ক্যাটেল ফিড, গমসহ কয়েক রকম ভুসি, সরিষার খৈল, খড় ও কাঁচা ঘাস। এর মধ্যে প্রতিটি প্রাণিখাদ্যের দামই বেড়েছে ৪০ থেকে ৮৭ শতাংশ। বড় খামারিরা খাদ্য উপাদান কিনে নিজেরা তৈরি করে পশুকে খাওয়ান। গত এক বছরে এসব খাদ্য উপাদানের দামও বেড়েছে ৪০ শতাংশের ওপরে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচও বাড়তি গুনতে হবে খামারিদের।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, গবাদিপশুর উৎপাদনে ৬৫ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচই হয় খাদ্যে। এ ছাড়া শ্রমিক, ওষুধ, আনুষঙ্গিক মিলিয়ে বাকি ২৪ শতাংশ খরচ হয়। বাণিজ্যিক খাদ্য তৈরিতে প্রধান খাদ্য উপকরণ হচ্ছে সয়ামিল, ভুট্টা, এক্সট্রাকশন, চালের গুঁড়া, গমের ভুসি, ডালের ভুসি ইত্যাদি। গত এক বছরে সয়ামিল রপ্তানি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাজারে সরাসরি খাদ্য ও খাদ্য উপাদানের দাম বেড়েছে গড়ে ৪৬ শতাংশ, যা গরু লালন-পালনের মোট খরচের ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে গবাদিপশু পালনে ১০০ টাকায় ৩০ টাকা বেশি খরচ হয়েছে শুধু খাদ্যেই। বেড়েছে অন্য খরচও। সে হিসাবে খামারি ও চাষিরা যদি কমপক্ষে এই ৩০ শতাংশ খরচও সমন্বয় করেন, তবে তাঁরা লাভের আশা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেনের রাজধানীর বছিলায় ‘সাদিক এগ্রো’ নামে খামার রয়েছে। কোরবানির ঈদ ঘিরে তাঁর খামারে পশু বিক্রি এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। অনেকে বুকিং দিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর তাঁর খামার থেকে ২৯ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছিল। তিনি বলেন, গত বছর ক্রেতারা যে গরু এক লাখ টাকায় কিনতে পেরেছিলেন, এবার তা কিনতে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা লাগবে। এরই মধ্যে বাজারে গরুর দাম ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

ছোট পশুর চাহিদা থাকবে বেশি: ২০১৭ সাল থেকে ছাগল ও ভেড়ার চেয়ে গরু-মহিষ কোরবানি দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। তবে গত বছর এতে ছেদ পড়ে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছর ছাগল ও ভেড়া কোরবানি হয়েছে ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি; গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি। যেখানে করোনার আগে ২০১৯ সালে ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৪৩৪টি গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছিল এবং ছাগল ও ভেড়া হয়েছিল ৪৯ লাখ ১ হাজার ১৮৮টি।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এবারও ছোট গরু কিংবা ছাগল ও ভেড়ার দিকে ঝুঁকতে পারেন ক্রেতারা। এ ছাড়া দেশে মোট কোরবানির সংখ্যাও কমতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ২১ লাখ মানুষ। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হয় পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে বা নিম্নমানের পণ্য কিনছে কিংবা একেবারেই কিছু পণ্য বাদ দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কোরবানির সময় মানুষের খরচের যে পরিকল্পনা থাকে, তা এবার সম্ভব নাও হতে পারে।

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, গত দুই বছর কোরবানির সময় লকডাউন ছিল। এবার সে পরিস্থিতি নেই, ফলে গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়তি চাহিদা থাকতে পারে।

ঢাকায় বসবে ১৭ অস্থায়ী হাট: এবার রাজধানীর দুই সিটিতে অস্থায়ী ১৭টি পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দায়িত্বে থাকবে সাতটি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় থাকবে ১০টি হাট। তবে সারাদেশে কতটি হাট বসবে, সে তথ্য এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত বছর কাগজে-কলমে সারাদেশে বসেছিল ২ হাজার ৪০০টি হাট। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিটি হাটেই ভেটেরিনারি চিকিৎসক দল কাজ করবে। এবার ২৫ হাজার কসাইকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু জবাইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি ও যানজট নিয়ে শঙ্কা: কোরবানির হাটে সিন্ডিকেট, সড়ক ও বাজারে চাঁদাবাজি এবং যানজট নিয়ে উদ্বিগ্ন খামারিরা। তাঁরা বলছেন, এবার কোরবানি হবে ভরা বর্ষায়। ফলে যানজটে পড়তে পারে পশুবাহী ট্রাক। এ ছাড়া প্রতিবছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। এবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেই চক্র কাজ করছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বন্যার সুযোগ নিয়ে এবং অন্য এলাকায় গোখাদ্যের আগুনদামকে পুঁজি করে আগেই পশু কিনে নিচ্ছে ওই চক্র। তারা এ পশু কিনে ঢাকায় মজুত করছে বলে জানান ব্যাপারিরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের খামারি মকবুল হোসেন বলেন, কৃষকের হাতে কোনো গরু নেই। বন্যার পরপরই গ্রামের গরু শহর থেকে আসা ব্যাপারিরা কিনে নিয়েছেন।

এদিকে, পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে এবার আর পশুবাহী গাড়ি নৌপথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে হবে না। পশু ব্যবসায়ী ও খামারিরা বলছেন, রাজধানীর প্রবেশমুখের সড়কে তীব্র যানজট থাকে। এ নিয়ে এখনই সংশ্নিষ্টদের ভাবতে হবে। বন্ধ করতে হবে ঢাকার ভেতরে পশুবাহী গাড়িতে চাঁদাবাজি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, প্রাণিখাদ্যের দামের ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সহায়তা দরকার। খামারিরা যাতে ভালো দাম পান, সে জন্য গবাদিপশু পরিবহন এবং বিক্রিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, করোনাকালে খামারিদের প্রণোদনা ও ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করাসহ নানা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ফলে বেড়েছে পশু উৎপাদন। দেশি পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মিটবে বলে প্রতিবেশী দেশ থেকে পশু আনা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

সুত্র-সমকাল

আরো পড়ুন : আজ ১২ জুন; আজকের দিনে জন্ম-মৃত্যুসহ যত ঘটনা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *