জান্নাতুল ফেরদৌসের মন–মেজাজ খারাপ। কারও সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না। কাউকে বিশেষ পাত্তাও দিচ্ছে না। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সপ্তম তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি সে। তার একমাত্র সঙ্গী এখন গোলাপি রঙের একটি পুতুল। মা–বাবার সঙ্গে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে থাকে জান্নাত। ডেঙ্গু হওয়ায় ছয় দিন আগে তাকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জান্নাত ছিল হাসপাতালের মেঝেতে পাতা শয্যায়। এক হাতের শিরায় স্যালাইন চলছে। আরেক হাতে ধরে রেখেছে পুতুল। এই পুতুলের সঙ্গেই সে কথা বলে। পায়ের কাছে বসে ছিলেন জান্নাতের বাবা। তিনি জানান, চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ নেই। তবে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললেও মেয়ে সুস্থ না হওয়াটা তাঁদের ভয় বাড়িয়েছে।
পুতুলের নাম জানতে চাওয়ায় মনে হয় কিছুটা বিরক্তই হলো জান্নাত। পুতুলটাকে আড়াল করে নিল। ওর বাবা বললেন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে মেয়ের। এ অবস্থা ডেঙ্গু হওয়ার পর থেকে।
তবে মুগদা হাসপাতালে শিশুদের জন্য নির্ধারিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি সব শিশুর অবস্থা এমন নয়। কেউ কেউ চেষ্টা করছে দুর্বল শরীর, পাংশু মুখেও প্রাণের উচ্ছ্বলতা দেখাতে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ঢুকতেই যেমন দেখা গেল স্যালাইন হাতে হেঁটে চলেছে এক কন্যাশিশু। ওর এক স্বজন ধরে রেখেছেন স্যালাইনের ব্যাগটি। ক্যামেরা আর মানুষ দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাদের পরিচয় জানতে চাইল সে। নিজের পরিচয় দিয়ে শিশুটি বলল, তার নাম নাফিসা আক্তার। থাকে শনির আখড়ায়। তিন দিন হলো ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। এখন যে ওর শরীর একটু ভালো সেটিও জানাল নিজে থেকেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া তথ্য বলছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রতি চারজনের একজন শিশু। চিকিৎসকেরাও বলছেন, এবার ডেঙ্গুতে শিশুদের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বললেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বেশি। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কাশি বেশি হচ্ছে শিশুদের। দ্রুত তাদের শরীরের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বলে ধারণা করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে গত কয়েক দিন হলো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।’
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেল, মঙ্গলবার সেখানে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৭৫। গত এপ্রিল মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর এই হাসপাতালে একসঙ্গে ছয় শ রোগী ভর্তি থাকার রেকর্ডও আছে।
রাজধানীর মান্ডা থেকে আসা ৯ বছরের তাবাসসুম আক্তারের পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছেন মা সেলিনা বেগম ও বাবা মো. কামাল শিকদার। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে তাবাসসুম তখন সবে উঠে বসেছে। ওকে রক্ত দেওয়া হচ্ছিল। রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) নেমে এসেছে ১২ হাজারে।
গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হয় তাবাসসুম। পরদিন ওর রক্তে অণুচক্রিকা ছিল ৩৫ হাজার। বাবা মো. কামাল শিকদার মেয়ের স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার সব কাগজপত্র এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আমি নিজেও তো বুঝতে পারছি না ১২ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে আমার মেয়ে বসে আছে কেমনে। প্লাটিলেট দ্রুত যেমন কমছে, তেমনি বাড়ছে। ভয় লাগতেছে আবার মেয়েকে দেখে ভরসাও পাচ্ছি।’
সোয়া দুই বছরের নাফিসা আক্তারের গায়ে হলুদ রঙের জামা। ক্যামেরা দেখে চোখ বড় হলো তার। চার দিন হলো ও হাসপাতালে ভর্তি। পায়ের কাছে বসে থাকা ওর মা বললেন, মেয়ের শরীর আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। এ সময় মুখে আঙুল দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকাল ছোট্ট নাফিসা।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঠিক এক মাস আগে গত ১৪ জুলাই দেখা হয়েছিল ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি সাড়ে তিন বছরের মাসুমার সঙ্গে। এক হাতে ক্যানুলা আর অন্য হাতে সাদা ফুলের গোছা ধরে রেখেছিল। তার মা বলেছিলেন, হাসপাতালের নিচতলা থেকে ফুল ছিঁড়ে এনেছে সে।
মাসুমা এসেছিল রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি থেকে। আজ ১৫ আগস্ট দুপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের নির্ধারিত ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, মাসুমার সেই শয্যায় অন্য এক শিশু ভর্তি। জানা গেল, ফুল হাতে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ানো মাসুমা বাড়ি ফিরেছে ‘অনেক দিন’ হলো।
আরো পড়ুন : ফেইসবুক পোস্ট নিয়ে ভোলাহাটে শিবির নেতাকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ