‘ও আম্মুরে…’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন শিশু আয়াতের বাবা

ওকে নিউজ স্পেশাল ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ শিশু অধিকার শিশু নির্যাতন শিশু/কিশোর

উশকোখুশকো চুল। দেবে গেছে চোখ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন। জীর্ণ শরীর হয়েছে আরও শীর্ণ। হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন মাটিতে। সামনেই পলিথিনে মোড়ানো কলিজার টুকরা সন্তান আলীনা ইসলাম আয়াতের বিচ্ছিন্ন মাথা। একদিন আগেও মেয়ের মায়াবী চেহারাটি শেষবারের মতো দেখার আকুতি জানিয়েছিলেন হতভাগ্য বাবা সোহেল রানা। কিন্তু প্রাণপ্রিয় সন্তানের এমন বীভৎস চেহারা দেখবেন- তা ভাবেননি। পলিথিনের আবরণ সরাতেই তাই ‘ও আম্মুরে…’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। সন্তানের খণ্ডিত মাথাটি বুকে টেনে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ‘বাবার দিকে তাকাওনারে মা, আমি যে তোমাকে নিতে এসেছি’- এভাবে আকুতি করছিলেন তিনি। কিন্তু ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া নিথর ছোট্ট মুখটি নিষ্পলক চেয়েছিল আকাশের দিকে।

আয়াতের বাবার আহাজারিতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কান্নার রোল পড়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়েন দাদা, দাদি, নানিসহ স্বজনরা। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন সাধারণ মানুষ। তারা ‘খুনি’ আবীর আলীর ফাঁসি দাবি করেন।

বৃহস্পতিবার সকালে নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী মৎস্যজীবী ঘাটের পাশে খালের মোহনায় পলিথিনে মোড়ানো খণ্ডিত মস্তকটি পাওয়া যায়। আগের দিন বুধবার একই খালের স্লুইসগেটের মুখ থেকে দুটি পা উদ্ধার করে পিবিআই। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জিজ্ঞাসাবাদে আবীর আয়াতকে ছয় টুকরো করে খালে ও সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার তথ্য দিয়েছিল। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বুধবার দুই পা উদ্ধার হয়। এবার মাথাটি পাওয়া গেল। আয়াতের লম্বা চুলে লাগানো ক্লিপটিও ছিল অক্ষত। এবার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ, দুই হাত, পরনের হিজাব ও জামার সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পিবিআই।

গত ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা নয়ারহাট এলাকার ওয়াজ মুন্সীর নতুন বাড়ির বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছর বয়সী আয়াত। নিখোঁজের তদন্তে নেমে ১০ দিন পর আয়াতদের ভাড়াটিয়া আজহারুল ইসলামের ১৯ বছর বয়সী ছেলে আবীরকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে সে আয়াতকে নৃশংসভাবে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। বিষয়টি আয়াতের পরিবারের সদস্যদের জানালে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁরা। কারণ তাঁদের চোখের সামনেই জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা আবীরের। আয়াতকে আদরও করত আবীর। ডাকত চাচ্চু। সে কীভাবে খুন করল নিষ্পাপ শিশুটিকে?

সাগর উপকূলে মস্তকটি কুড়িয়ে পাওয়া জেলে দিদার হোসেন সমকালকে বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরে সকালে ঘাটে আসি। নাস্তা করে আবার বোটে যাচ্ছিলাম। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে আসা ময়লার স্তূপের মধ্যে স্কচটেপ মোড়ানো একটি পোঁটলা পড়ে আছে দেখতে পাই। সেটি হাতে নিয়ে স্কচটেপ খুলতেই চুল বেরিয়ে আসে। তখন আয়াতের মরদেহ উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত লোকজনকে জানালে তারা এসে মাথাটি উদ্ধার করে।’

উদ্ধার অভিযানে থাকা পিবিআই মেট্রোর উপপরিদর্শক জাহেদুজ্জামান চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘টানা ছয় দিন ধরে খালে ও সাগরপাড়ে শিশুটির মরদেহের খোঁজে কাজ করছিলাম আমরা। সকালেও খালে নামার জন্য এসেছি। এ সময় এক জেলে চিৎকার করে পোঁটলা পাওয়ার কথা জানান। গিয়ে দেখি পোঁটলাটিতে আয়াতের খণ্ডিত মস্তক।’

বুধবার আয়াতের দুই পা পাওয়ার পর থেকে দিশেহারা বাবা সোহেল রানা সারারাত ঘুমাননি। সকাল হতেই সন্তানের লাশের টুকরোর খোঁজে ছুটে আসেন সাগরপাড়ে। উপকূলে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে খবর পান, মাথা পাওয়া গেছে। ছুটে আসেন তিনি। বিরামহীন কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর সঙ্গে থাকা স্বজনরাও বিলাপ করেন।

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আকমল আলীর ঘাটের স্লুইসগেটে সুরতহালের জন্য পলিথিনে মোড়ানো মস্তকটি যখন খোলা হয়, তখন আর্তনাদ করে উঠেন বাবা সোহেল রানাসহ স্বজনরা। আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘বাবারে, বাবারে, ও আম্মুরে এই তো বাবা। বাবা তোমাকে নিতে আসছি। ও বাবারে। বাবার দিকে তাকাওনারে মা। ও মা একবার বাবার দিকে তাকাওনারে। এই যে বাবা। আমারে সঙ্গে করে নিয়ে যাওনারে মা। আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে কেমনে মারল। যখন মারছিল তখন কি বাঁচার জন্য আব্বু, আব্বু করে চিৎকার করছিল।’ এ সময় বিলাপ করতে করতে বারবার আয়াত, আয়াত বলে ডাকছিলেন দাদি রিনা আক্তার।

আয়াতের দাদা মনজুর হোসেন বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে আবীরের পুরো পরিবার দায়ী। আমরা তাদের দ্রুত বিচার চাই। অবিলম্বে আবীরের ফাঁসি চাই। তাকে প্রকাশ্য ফাঁসি দেওয়া হোক, যাতে এ ধরনের নৃশংস অপরাধ আর কেউ না করে।’

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আবীর জানিয়েছিল, আয়াতকে খুন করে ছয় টুকরো করে দুই পা ও মাথা খালে ফেলেছে। শরীরের বাকি অংশ ও দুই হাত সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দুই পা ও মাথা খালে পেয়েছি। বাকি অংশগুলো উদ্ধারের জন্য অভিযান অব্যাহত থাকবে। এখন আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী দেহের অংশগুলো সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হবে। এর পর ডিএনএ পরীক্ষা করে লাশ পরিবারকে হস্তান্তর করা হবে।’

আরো পড়ুন : রাউজানে নিখোঁজের ৪ দিন পর নালায় মিলল গৃহবধূর লাশ

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *