কয়েক দিন ধরেই দমবন্ধ গরম ছিল। গতকাল বুধবার কোথাও মধ্যরাত আবার কোথাও ভোরের আলো ফোটার পর শুরু হয় তীব্র কালবৈশাখী। ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে হয় বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি। এতে প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেলেও কালবৈশাখীর ছোবলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি ও গাছপালাও। অনেক স্থানে খুঁটি উপড়ে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। দেশের নদীবন্দরগুলোয় এক নম্বর সতর্কসংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, ঢাকায় ঝড়ের সময় বিমানবন্দর আবহাওয়া স্টেশনে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয়। আর আগারগাঁও এলাকায় বাতাসের গতি ওঠে ৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। ওই সময় ঢাকায় ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তবে ঢাকায় ঝড়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য আসেনি ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে কালবৈশাখীতে ঘরচাপা পড়ে শ্বশুর ও পুত্রবধূর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তেঁতুলিয়া নদী তীরবর্তী শ্রীপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- রুস্তম আলী হাওলাদার (৭০) ও তার ছেলে বারেক হাওলাদারের স্ত্রী জয়নব বেগম (৩৫)। সকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে গাছচাপায় রিনা আকতার (৪০) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা উত্তর কাঞ্চননগর ঝরঝরি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত গৃহবধূ ওই এলাকার শাহ আলমের স্ত্রী।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের মধ্য কেরোয়া গ্রামের হানিফ মাঝির বাড়িতে কালবৈশাখীর সময় ভেঙে পড়া নারকেল গাছের চাপায় সকাল ৯টার দিকে রুহুল আমিন (৬৩) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি মৃত সফি উল্যার ছেলে।
কুমিল্লায় কালবৈশাখীতে গতকাল সকাল ৭টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা অবস্থায় গাছ পড়ে শিশু মিয়া (৬০) নামে একজন মারা গেছেন। মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানাধীন রামচন্দ্রপুর-শ্রীকাইল সড়কের সলফা নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। এতে তিন বছরের শিশুসহ আরও পাঁচজন আহত হন। বগুড়ার নন্দীগ্রামে কালবৈশাখীতে শজনে গাছের ডাল ভেঙে রেজাউল করিম রেজু (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গতকাল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলার ভাটগ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। নিহত রেজাউল একই গ্রামের মৃত ইশার উদ্দিনের ছেলে।
এদিকে শিলাবৃষ্টি ও অল্প সময়ের ঝড়ে ভেঙে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। ঝড়ের তাণ্ডবে উঠতি ইরি-বোরো ফসল মাটিতে লুটিয়ে গেছে। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিঠু চন্দ্র অধিকারী জানান, ঝড়ে তার উপজেলায় আনুমানিক ৩৪৫ হেক্টর জমির ধান হেলে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে গতকাল ভোর ৪টার দিকে কালবৈশাখীতে ফসলি মাঠে থাকা পাকা এবং আধাপাকা বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের জমিতে পানি জমে গেছে। ফলে পাকা ও আধাপাকা ধানের শীষ জমিতে জমে যাওয়া পানিতে ডুবে আছে। ঝড়ে নাটোরের সিংড়ায় প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির উঠতি বোরো ধান গাছ নুইয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে শত শত হেক্টর জমির ধান, পাট, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন সবজিক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
রংপুরের মিঠাপুকুরের বালুয়া মাসিমপুর, মিলনপুর ও বড়বালা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে চলে কালবৈশাখীর তাণ্ডব। সঙ্গে ছিল শীলাবৃষ্টি। এতে উপজেলার ১৭ ইউনিয়নে রবিশস্য, বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। অনেক স্থানে কলাবাগান উপড়ে পড়েছে। শিলাবৃষ্টিতে অন্তত এক হাজার বসতঘরের টিনের চালা ফুটো হয়েছে। এ উপজেলায় এক হাজার পঞ্চাশ হেক্টর জমির হাঁড়িভাঙা আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, শিলাবৃষ্টিতে সাত হেক্টর আবাদি জমির ধান, দুই হেক্টর ভুট্টাক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁড়িভাঙা আমের গুটিও নষ্ট হয়েছে।
খাগড়াছড়ির গুইমারার বড়পিলাক এলাকার ফল বাগানি সাইফুল বলেন, আগামী মাসে আম বাজারজাত করার প্রস্তুতি ছিল। হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় বাগান লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে গুইমারায়। বাড়িঘরে গাছপালা পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঝড়ে অনেক স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়ে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহও ব্যাহত হয়। মিরসরাইয়ে কালবৈশাখীতে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর মিরসরাই জোনাল অফিসের ডিজিএম সাইফুল আহম্মদ জানান, ঝড়ে বিদ্যুৎ লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ লাইনের পাঁচটি খুঁটি, ১০৩টি মিটার ভেঙে গেছে। অসংখ্য জায়গায় লাইনের তার ছিঁড়ে গেছে।
ঝড়ে গাছের ডালপালা ভেঙে পৌনে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা। গতকাল দুপুরে লাকসামের পশ্চিমগাঁও সামনির পুলের গোড়ায় কালবৈশাখীতে তিনটি বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়ে যায়। এতে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায়।
ঝড়ে গতকাল ভোর থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের মাঝিরকান্দি, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাটে ফেরি চালাচল দুই থেকে তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এতে ঘাটের দুই পাশে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।
(রিপোর্টটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি)
আরো পড়ুন : এডিসি হারুন পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারার ভিডিও ভাইরাল