র্যাবের হাতে আটক সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটচনায় ফরেনসিকে আঘাতের চিহ্ন, সুরতহালে নেই
নওগাঁর সরকারি কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের নামে মামলা না থাকার পরও কোন ক্ষমতাবলে র্যাব তাঁকে তুলে নিয়েছিল– তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় র্যাব গ্রেপ্তারের এখতিয়ার রাখে কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার একটি রিট আবেদনের শুনানিকালে এ প্রশ্ন তোলেন। একই সঙ্গে আটকের পর থেকে সুলতানাকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা কিংবা কার্যালয়) নিয়ে র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল কিনা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত র্যাবের আচরণ আইনসিদ্ধ ছিল কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি চূড়ান্ত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে সুলতানার মৃত্যুর কারণ কী চিহ্নিত হয়, সেসব তথ্যও হাইকোর্টে জানাতে বলা হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এসব বিষয়ের তথ্য এবং এ-সংক্রান্ত আইন, নথি ও সুলতানার ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ওই দিন বিষয়টি ফের শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসবে।
এদিকে, গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, একজন যুগ্ম সচিবের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নারীকে আটক করা হয়েছিল। নওগাঁয় সুলতানাকে র্যাব আটক করার সময়ও ওই যুগ্ম সচিব উপস্থিত ছিলেন। ওই নারীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ছিল।
এদিকে, সুলতানার মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখতে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে র্যাব। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
আঘাতের চিহ্ন সুরতহালে নেই : সুলতানার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সুলতানার কপালের বাঁ পাশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা বলেন। একই ধরনের আঘাতের কথা জানিয়েছিলেন রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে মাথায় আঘাতের কথা উল্লেখ করেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘মাথার আঘাত তিনি দেখতে পাননি।’
২২ মার্চ নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে সুলতানাকে আটকের পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার রাজশাহীর স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হক। যখন তিনি মামলা করেন, তখন সুলতানা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
যুগ্ম সচিব এনামুল হক সোমবার বলেছিলেন, ‘সুরতহাল প্রতিবেদনে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের উল্টো দিকে কালো দাগ ছিল। সেটা স্যালাইন ও রক্ত দেওয়ার কারণে হয়েছে।’ কীভাবে সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য জানলেন– এ ব্যাপারে কথা বলতে মঙ্গলবার তাঁকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
অন্যদিকে, রামেকের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কফিল উদ্দীন বলেন, ‘সুলতানার কপালের বাঁ পাশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার কেন উল্লেখ করেননি, তা আমার জানার কথা নয়। আমরা তিন সদস্যের একটি কমিটি করে ময়নাতদন্ত করেছি। লাশের ফরেনসিক নমুনা আমরা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। সেটার প্রতিবেদন এলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ বলেন, ‘চিকিৎসা দেওয়ার সময় ডান পাশে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। তবে ফরেনসিক বিভাগ যদি বাঁ পাশে আরেকটি আঘাত দেখে থাকে, সেটাই চূড়ান্ত। তারা কাপড় খুলে চুল কেটে নিখুঁতভাবে দেখে।’
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার বলেন, ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ পেয়ে আমি শুধু সুরতহাল করেছি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল কিনা, তা দেখেছি। লাশের শরীরের শুধু কনুইয়ের উল্টোদিকে কালো দাগ পেয়েছি। এর কারণ অজানা। মাথায় আঘাতের বিষয়টি আমি বলতে পারব না। এটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমার সুরতহাল প্রতিবেদনে ফরেনসিক বিভাগের প্রধানের স্বাক্ষর আছে।’
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) রাজশাহী ইউনিট সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট সামিনা বেগম বলেন, ‘যুগ্ম সচিব এনামুল হক তাঁর অধীন এক ছোট কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন র্যাবকে ব্যবহার করলেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।’
রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ইসমত আরা বলেন, ‘একটা মেয়ে একা থাকেন। সুস্থ মেয়ে অফিসে যাচ্ছেন। সেই মেয়েটি হঠাৎ এতটাই অসুস্থ হয়ে গেল যে তাঁকে হাসপাতালে নিতে হলো। এর পর মারাই গেল। এ ঘটনার পেছনের আসল রহস্য বের হওয়া উচিত।’
সুলতানার ভাই সোহাগ মিয়া বলেন, ‘আমার ভাগনে শাহেদ এখন তার মামার বাসায় আছে। মায়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে। আপাতত কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। আমার বোনের সঙ্গে কী ঘটেছে– সবাই জানে। এসব নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। মামলাও করব না। এসব করে কী হবে! মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শাহেদ তার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে গ্রামে এসেছে। বন্ধুরা এত দিন তাকে সঙ্গ দিয়েছিল। ওরা চলে যাওয়ায় কিছুটা একা হয়ে পড়েছে।’
রাজশাহী র্যাবের অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘সুলতানার ছেলে নওগাঁতেই আত্মীয়ের বাসায় আছে। সে ভালো আছে।’
নওগাঁর পুলিশ সুপার রাশিদুল হক বলেন, ‘সুলতানাকে আটকের আগে বিষয়টি জেলা পুলিশের কোনো শাখাকে জানানো হয়নি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে অবশ্যই তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’
ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রতারণা : কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যুগ্ম সচিবের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র প্রতারণা করছিল। এ বিষয়ে ২০২২ সালের মার্চে প্রথমে জিডি করেন এনামুল হক।
অভিযোগকারী কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে চক্রটিকে ধরার চেষ্টা করছিলেন জানিয়ে মঈন জানান, সর্বশেষ ১৯ ও ২০ মার্চ তাঁর নাম ব্যবহার করে টাকা নেওয়ার তথ্য পান তিনি। প্রাথমিকভাবে তিনি জানতে পারেন, ওই ঘটনার সঙ্গে আল আমিন নামের এক ব্যক্তি যুক্ত। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন সুলতানা।
সুরতহাল প্রতিবেদন হাইকোর্টে : এদিকে, গতকাল দুপুরে শুনানিতে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল থেকে সুলতানার সুরতহাল প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী সুলতানা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁকে নির্যাতন করা হয়নি।
এর আগে গতকাল সকালে র্যাব হেফাজতে সুলতানার মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। জনস্বার্থে দায়ের করা রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, র্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
শুনানি শেষে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, সুলতানাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি র্যাব হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি– এমন দাবি একেবারেই ভুল।
নওগাঁর হাসপাতাল ও র্যাব অফিসের কিছু নথি আদালতে উপস্থাপন করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুলতানাকে এক ঘণ্টার বেশি কিছু সময় হেফাজতে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা যে কোনো মামলার তদন্ত করার এখতিয়ার প্রাসঙ্গিক আইনে র্যাবের আছে।
মানববন্ধন : সুলতানার মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) নওগাঁ জেলা শাখা। মঙ্গলবার বিকেলে শহরের মুক্তির মোড়ে তারা এ কর্মসূচি পালন করে।
সুলতানা নওগাঁর সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী ছিলেন। বুধবার অফিসে যাওয়ার সময় নওগাঁর মুক্তির মোড় এলাকা থেকে তাঁকে আটক করে র্যাব। ওই দিন দুপুরে পরিবারের লোকজন জানতে পারেন, সুলতানা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বজনদের অভিযোগ, র্যাব হেফাজতে নির্যাতনের কারণে সুলতানা মারা গেছেন। তবে র্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
আরো পড়ুন : টঙ্গীতে স্টিল মিলের ভয়াবহ কালো ধোঁয়ায় ছড়াচ্ছে বিষ, জনস্বাস্থ্যে হুমকি