দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন তলানিতে এসে ঠেকেছে। অবস্থা এমন যে, অনেক ভালো শেয়ারেরও এখন ক্রেতা নেই। গতকাল মঙ্গলবার দুই কার্যদিবস পর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মূল্য সূচক কিছুটা বাড়লেও এদিন এ বাজারে লেনদেন আড়াইশ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। যা ডিএসইতে চলতি বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন। শুধু তাই নয়, এই লেনদেন গত ২০ মাসের মধ্যেও সর্বনিম্ন। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই চিত্র। গতকাল দুই বাজারের লেনদেন মিলিয়েও ৩০০ কোটি টাকা পার করতে পারেনি। ডিএসই ও সিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, করোনা মহামারি ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত। এর প্রভাব পড়েছে দেশেও। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পর্যন্ত আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়েও এর প্রভাব পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, শেয়ারবাজারে অধিকাংশ কোম্পানিই এখন ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। এতে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর মূলধন আটকে গেছে। তারা লেনদেন করতে পারছে না। ফলে দিনদিন লেনদেন তলানিতে নেমে আসছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতকাল ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের কার্যদিবসের চেয়ে ১৬.৪৫ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২২৯.০১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এছাড়া, ডিএস-৩০ মূল্য সূচক ৭.০১ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ২০৫.৫৮ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস শরিয়াহ সূচক (ডিএসইএস) ৪.৫২ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৬৪.০৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গতকাল এই বাজারে মোট ২৭১ কোটি ৯৭ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফন্ডের লেনদেন হয়েছে। যা আগের দিনের চেয়ে ৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা কম। আগের দিন ডিএসইতে ৩৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। গতকাল লেনদেনকৃত মোট ৩০৩টি কোমপানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৫০টির, কমেছে ২৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২২৮টি কোম্পানির শেয়ার।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক বাড়লেও লেনদেন হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা। গতকাল সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪১ পয়েন্ট বেড়ে ১৮ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, সিএসসিএক্স ২৫ পয়েন্ট বেড়ে ১১ হাজার পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ৪০ পয়েন্ট বেড়ে ১৩ হাজার ২৬৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। গতকাল এই বাজারে মোট ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। লেনদেনকৃত মোট ১২৯টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৩টির, কমেছে ২১টির এবং অপরিবর্তিত আছে ৭৫টির।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে লেনদেনের যে চিত্র তাতে করোনাকালের সেই সময় যেন আবারও ফিরে এসেছে। গত আট কার্যদিবসের মধ্যে পাঁচ দিনই ৩০০ কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হয়েছে। আর গতকাল তা আড়াইশ কোটির ঘরে নেমে এসেছে। এর আগে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা আট কার্যদিবস ২০০ কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হয়েছিল। ঐ বছর ১৯ মার্চ মাত্র ৪৯ কোটি ১২ লাখ ১৬ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়। ২৬ মার্চ থেকে ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। পরে দুই মাস লেনদেন বন্ধ থাকার পর ঐ বছর ৩১ মে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হয়। তবে লেনদেন ১০০ কোটি টাকারও নিচে নেমে আসে। পরে ধীরে ধীরে লেনদেন বাড়তে থাকে। কিন্তু এখন আবার পুঁজিবাজারে লেনদেনে সেই ২০ মাস আগের চিত্র।
কিন্তু কেন এ অবস্থা? এ প্রসঙ্গে গত সোমবার রাজধানীতে ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস ও জ্বালানি তেল উত্পাদনকারী দেশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এই সেমিনারে তিনি বলেন, জ্বালানির ওপর যখন প্রভাব পড়ে, তখন সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে। যুদ্ধ শুরুর পর যে ধাক্কা এলো তাতে আমাদের সবকিছু অন্যরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। যেখানে আমাদের বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত থাকার কথা, সেখানে লোডশেডিংয়ের ধাক্কা এলো। যে দেশের মানুষ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেই দেশে আমাদেরকে সরকারিভাবে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। আমাদের দেশে ঠিক উলটো। যেখানে ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, সেখানে আমাদেরকে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। সে কারণে আমরা ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সাময়িক একটা ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না জানিয়েছেন তিনি। সেমিনারে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, আমাদের বাজারে জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম। তারা অন্যের কথা শুনে বিনিয়োগ করে। এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আরো পড়ুন : প্রথমবারের মতো শেষ আটে মুসলিম দেশ মরক্কো; ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে জয় উদযাপন