খুলনা ব্যুরো : গত বুধবার রাত ৮টা। খুলনা মহানগরীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীন রোডের একটি দোকানে বসেছিলেন সোহেল জমাদ্দার (৩২)। এসময় কয়েক জন যুবক ঘিরে ধরে তাকে। একপর্যায়ে সে দৌড় দিলে ঐ যুবকরা তাকে পেছন থেকে গুলি করে। গুলিটি তার পিঠের ডান পাশে লেগে বুকের বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শুধু ঐ ঘটনাটিই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে খুলনায় সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতি রাতেই নগরীসহ জেলার কোথাও না কোথাও ঘটছে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, গোলাগুলি ও খুনসহ সন্ত্রাসী ঘটনা। গত চার মাসে খুলনা মহানগরীসহ জেলায় ২৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দীর্ঘ চার মাস পেরিয়ে গেলেও খুলনায় পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি পুলিশ। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নগরীর নিরালা এলাকায় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে এসে একদল সন্ত্রাসী এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পথচারী ইউনুস শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এর পর সন্ত্রাসীরা চাঁনমারি এলাকায় গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া ঐ এলাকার আব্দুল আহাদ হাওলাদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে।
গত ২৯ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা নগরীর টুটপাড়া এলাকায় এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এর পর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর জখম করে। পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৪ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সন্ত্রাসী আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক, তার ভাই সজীবসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে খুলনা সদর থানায় মামলা করেন নিহত বোয়িং মোল্লার ছোট ভাই মো. আবদুল্লাহ। ঐ ঘটনার আগের দিনও সন্ত্রাসীরা বোয়িং মোল্লার ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তবে দৌড়ে পালিয়ে সেদিন জীবন রক্ষা করেন তিনি।
এর আগে ২ নভেম্বর রাতে নগরীর আলকাতরা মিল এলাকায় সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে পঙ্গু রাসেল নামে এক যুবককে হত্যা করে। এ সময় সজীব ও ইয়াসিন নামে দুই যুবককে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। একই রাতে নগরীর বাবু খান রোডে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রহমান বেলালকে আহত করে।
গত ৫ নভেম্বর রাতে নগরীর বসুপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা রফিকুল ইসলাম মুক্তা নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালায়। গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নগরীর দৌলতপুর থানার কালীবাড়ি বাজারের দত্ত জুয়েলার্সে ডাকাতি করে। তারা জুয়েলার্স থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ ২ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।
গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সবজি বিক্রেতা নাঈম সানা গুলিবিদ্ধ হন। ৬ ডিসেম্বর বিকালে রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমরান হোসেন মানিক নামে এক যুবক আহত হন।
এছাড়া গত ২১ অক্টোবর রাতে কয়রা উপজেলার কাটাখালী গ্রামে পুলিশের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা অপহরণ মামলার আসামি হারুন গাজীকে ছিনিয়ে নেয়। তাদের হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাতের আঁধারে সন্ত্রাসীরা নগরীর বিভিন্ন জায়গায় মোটরসাইকেলে মহড়া দিচ্ছে। যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এদিকে, নগরীর জিন্নাহপাড়া, মোল্লাপাড়া, লবণচরা ও শিপইয়ার্ড এলাকার কয়েক জন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। মাদক বেচাকেনাও বেড়েছে। নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীতে আগের মতো পুলিশের টহল ও অভিযান দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া কারাগারে থাকা বেশ কয়েক জন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরেছে। পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ও বখাটেরা। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।
এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত চার মাসে খুলনা মহানগরীসহ জেলায় ২৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খুলনা মহানগরীতে সাতটি ও জেলায় ১৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, খুলনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা চরমে। সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন ও যৌথ বাহিনী মাঠে থাকলেও তারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। যদিও তারা দাবি করেন যে, তারা এ ব্যাপারে সক্রিয় কিন্তু চোখের সামনে প্রতিনিয়ত যা দেখছি, তাতে আমরা শঙ্কিত। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে সবাইকে যেতে হচ্ছে।
খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, নগরীতে পুলিশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের ভূমিকা এখনো সন্তোষজনক না। ফলে খুলনা মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় চুরি-ডাকাতি বেড়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) আহসান হাবিব বলেন, গত চার মাসে খুলনা মহানগরীতে সাতটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে মহানগরী এলাকায় প্রবেশ করে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করছে। তবে প্রতিটি ঘটনাতেই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া অ্যাকটিভ পুলিশিং করে অপরাধ দমন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মহানগর পুলিশ দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারব।
খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুশান্ত সরকার বলেন, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, পূর্বশত্রুতা, মাদক ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। তবে পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থায় রয়েছে।
আরো পড়ুন : দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় এক হাজার ছাড়াবে