ভোটের মাঠে নৌকা ও স্বতন্ত্রের লড়াই থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ থামছেই না। বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় দফায় দফায় সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন নিজ দলের নেতা-কর্মীরাই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড মানছে না কোনো পক্ষই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ঘরের এই লড়াই থেকে দিন দিন সংঘাত-সংঘর্ষ চরম রূপ নিতে পারে। এই বিবাদ ক্ষমতাসীন দলকেই সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে তুলতে পারে। এখন পর্যন্ত বিবাদ নিরসনে নেওয়া হয়নি কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপও। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের ভিতরে-বাইরে প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে মিটবে আওয়ামী লীগের ঘরের এই লড়াই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সবার একই আদর্শ। তারা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে হার-জিত থাকবেই। পরাজিত হলে দোষারোপ বা হামলা, কিংবা বিজয়ী হয়েছে বলেই পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করা মোটেও কাম্য নয়। হামলা-সংঘাত, সংঘর্ষ এটা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। গণতন্ত্রের সঙ্গে সংঘাত যায় না। যারাই সংঘাত-হামলার ঘটনা ঘটাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা সাংগঠনিক ও আইনগতভাবে। তাহলে এই বিবাদ মিটে যাবে। তাছাড়া কোনো উপায় নেই।’
জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, সংঘাত চলছেই। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না নৌকা বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এতে নিহত ও আহতরাও অধিকাংশ স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী বা কর্মী-সমর্থক। শনিবার রাতে নোয়াখালী-২ আসনের সোনাইমুড়ীর নাটেশ্বরে পলাশ (৩৫) নামে এক যুবককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতের মাথা থেঁতলানো অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নোয়াখালী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাঁচি প্রতীকের পরাজিত আতাউর রহমান ভুঁইয়া মানিক জানান, নিহত পলাশ তার নির্বাচনি এজেন্ট ছিলেন এবং তার পক্ষে কাজ করতেন। মুন্সীগঞ্জ সদরে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় অর্ধশত বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সদর উপজেলার চরাঞ্চলের আধার ইউনিয়নের সোলারচর ও বকুলতলা গ্রামে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই নারীসহ তিনজন। স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও গরু-ছাগল লুটে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের পরাজিত নৌকা সমর্থন করায় একই আসনের জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী ফয়সাল বিপ্লব সমর্থকদের বিরুদ্ধে এ হামলার অভিযোগ তাদের। সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, জামায়াত-বিএনপি থেকে আগত নৌকা সমর্থকরা আমার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। তাদের হামলা-মামলার কারণে নির্বাচনি এলাকার কমপক্ষে ২ হাজার নেতা-কর্মী ঘরছাড়া হয়েছে। নৌকার বিজয়ী মমিন মন্ডলের লোকজন এসবের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ তার।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হলেও স্বতন্ত্র ও নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ঘরের লড়াই যেন শেষ হচ্ছে না। কীভাবে শেষ হবে তারও সঠিক তথ্য নেই কারও কাছে। নির্বাচন শেষ হলেও এ পর্যন্ত কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। ২ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দলীয়ভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খুব শিগগিরই কমে আসবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন চলাকালীন দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা ছিল সবাই প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন, ভোট করতে পারবেন। যাকে খুশি ভোট দেওয়া ও চাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া যাবে না। সেই নির্দেশনা এখনো বলবৎ আছে। ভোট শেষে যারা সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে আইনগতভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কমপক্ষে ১৮১ আসনে নৌকার বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোটে নৌকা এবং লাঙলকে হারিয়ে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তারা স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা। ভোটে জয়ী দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতা হলেও নির্বাচনি ফয়সালার পর জয়ী ও পরাজিতের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হয়ে আছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা হুমকিতে পড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, রেষারেষি হবে বলে আমরা বিজয় মিছিল করিনি। ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় উৎসব পালন করেছি। সে কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আর ঘটবে না বলেই মনে করি। যদি কেউ ঘটায় তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর স্বতন্ত্র বনাম নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এটা একটি জটিল বিষয়, তারপরও বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। আমরা বড় দল, নেতা-কর্মীদের আশা-প্রত্যাশার জায়গাটাও বড়। সেখানে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন : নির্বাচন কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে জটিলতা তীব্র হচ্ছে