চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। গতকাল মঙ্গলবার রেকর্ড ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। উৎপাদনে এসেছে একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও। বেড়েছে গ্যাসের সরবরাহ। তার পরও দেশজুড়ে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলোতে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। ক্ষুব্ধ মানুষ বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ স্থাপনায় হামলা ও সড়ক অবরোধ করেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে বাঁচতে নিরাপত্তা চেয়ে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ অফিস।
কেন লোডশেডিং
রেকর্ড উৎপাদনেও লোডশেডিংয়ের কারণ হিসেবে সরকার অতিরিক্ত তাপমাত্রাকে দায়ী করছে। সক্ষমতা থাকার পরও লোডশেডিং হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব ১৫ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। গত রোববার সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। সেদিন সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট। সোমবার সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে যেতে সিস্টেম লস হয় প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট। ফলে চাহিদা আর সরবরাহের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়। এই ঘাটতি লোডশেডিং করে সামলায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো।
জ্বালানি (গ্যাস ও জ্বালানি তেল) সংকট এবং সংরক্ষণ ও মেরামতের কারণে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় কম। রোববার বিদ্যুতে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়। চাহিদা মেটাতে আরও কমপক্ষে ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। এখানে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া আশুগঞ্জ অঞ্চল থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। গরমের কারণে যন্ত্রপাতি রক্ষায় বিশ্রামে রাখতে হচ্ছে অনেক ইউনিটকে।
দুই বিতরণ কোম্পানির দু’জন কর্মকর্তা জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে যন্ত্রপাতি রক্ষায় অনেক সময় কিছু এলাকায় ফোর্স লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এ ছাড়া গরমে এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়েছে। তাঁদের মত, গরমের কারণে ৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা বেড়েছে। ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর অঞ্চলে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের দুর্বলতার কারণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।
গ্রামে লোডশেডিং বেশি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শহরে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও অন্যান্য এলাকায় চাহিদার চেয়ে অনেক কম বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। ফলে এক বা দুই ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। তবে এ বিষয়ে কেউ সরাসরি মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। কোথাও কোথাও টানা তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন গ্রাহক। স্থানীয় কিছু ত্রুটির কারণে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। এটাকে লোডশেডিং বলা যাবে না।
দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় তাঁরা লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
দেশের সবচেয়ে বেশি গ্রাহক রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের। এর ৮২টি সমিতির মধ্যে ৬৩টির অবস্থা নাজুক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী বলেন, তাঁরা ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। ফলে কোথাও কোথাও অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হয় না।
বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, গরমের কারণে এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়েছে। এতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। তাই কিছু এলাকায় সাময়িক ঘাটতি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গরমের কারণে চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আমরা ভেবেছিলাম, পিক সময়ে চাহিদা থাকবে ১৫ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সারাদিনই চাহিদা থাকছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে।
কষ্টে আছে মানুষ
গরমে লোডশেডিংয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ। গ্রামগুলোতে দিন-রাতে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। অনেক গ্রামে রাতে বিদ্যুৎ থাকেই না। এতে সেচকাজ ও শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, একবার কারখানা বন্ধ হলে আবার চালু করতে আরও ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এ অবস্থায় ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঢাকার শপিংমলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময়েও লোডশেডিং করা হচ্ছে না বলে জানায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। গ্রাহকরা বলেছেন, ঢাকায় দিনে সরবরাহ থাকলেও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে গভীর রাতে। ফলে রাতে ঘুমাতে পারছে না লোকজন।
হামলা-অবরোধ
ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ফেনীর ছাগলনাইয়ার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। রোববার রাতে এ ঘটনা ঘটে বলে ছাগলনাইয়া পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মো. জানে আলম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়ে অফিসের গেট, আসবাব, দরজা-জানালার কাচ ভাঙচুর করেছে। পরে রাতেই মামলা করেন ডিজিএম। এ ঘটনায় রাকিবুল হাসান শুভ নামে এক হামলাকারীকে আটকের পর গতকাল আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া আরও ৫ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা এখন পলাতক।
বিদ্যুৎ না পাওয়ায় সিলেটে মধ্যরাতে সড়ক অবরোধ করেছেন স্থানীয়রা। গত রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর নয়া সড়ক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ওই এলাকায় ইফতারের আগে থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ইফতার ও তারাবির নামাজ পড়ে রাত ১১টার দিকে বাধ্য হয়ে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেন। তিন দিন ধরে সিলেটের সব এলাকায়ই চলছে চরম বিদ্যুৎ বিভ্রাট।
নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি
চরম লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনগণের রোষানল থেকে বাঁচতে বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে নিরাপত্তা চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর পক্ষ থেকে এমন একটি চিঠি জেলার পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ময়মনসিংহ জোনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস এবং লো-ভোল্টেজের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহ অত্যন্ত কম থাকায় সমিতির আওতাভুক্ত এলাকায় বর্তমানে অসহনীয় লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র গরমের সময় অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রাহকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এবং সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক এলাকায় গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তর ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র স্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট স্থাপনা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিধানে সার্বিক সহযোগিতার অনুরোধ জানানো হয়। সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিও স্থানীয় প্রশাসনকে এমন চিঠি দিয়েছে।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর জেনারেল ম্যানেজার মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখনও কোথাও হামলা হয়নি। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে পরবর্তী ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, রাত-দিন মিলিয়ে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন ঠিক রাখতে পিডিবির কিছু বিদ্যুৎ শহর থেকে পল্লী বিদ্যুৎকে দেওয়া হচ্ছে।
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা জানান, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে কেউ যাতে নাশকতা বা ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সে বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ যেন আগে থেকেই জানিয়ে দেয়, কোন এলাকায় কখন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
আরো পড়ুন : নওগাঁর মান্দায় সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী নিহত, স্বামী আহত