*চব্বিশের ‘ছত্রিশে জুলাই’-এর মাহেন্দ্রক্ষণ ৫ আগস্ট, লাখ লাখ মানুষের প্রতিরোধের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা * প্রায় ১৫ শতাধিক শহিদ ও হাজার হাজার আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মুক্তিকামী মানুষের সবচেয়ে বড় গণ-অভ্যুত্থানের নাম ‘ছত্রিশে জুলাই বিপ্লব’। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এ অভ্যুত্থান দেশ ছাপিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে ছিল বড় এক বিস্ময়। শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ আপামরসাধারণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। একই সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান দলটির সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনমুখী বিক্ষুব্ধ লাখ লাখ মানুষের স্রোতে সদলবলে একরকম ভেসে যায় স্বৈরাচার। এভাবে ৫ আগস্ট দুপুরে স্বাধীন বাংলার বুকে রচিত হয় নতুন এক ইতিহাস।
প্রসঙ্গত, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এভাবে ক্ষমতা ছেড়ে কোনো সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তবে এরকম এক দানবীয় সরকারকে হটাতে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে বাংলার অকুতোভয় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতাকে। প্রায় দেড় হাজার মানুষকে স্বৈরাচারের তপ্ত বুলেটে জীবন দিতে হয়। ন্যক্কারজনক এ হত্যাকাণ্ডে শিশু থেকে বৃদ্ধ-কেউই বাদ যায়নি। ঘরের মধ্যেও কেউ নিরাপদ ছিলেন না। বুলেটে আহত হতে হয় হাজার হাজার যোদ্ধাকে। সারা জীবনের জন্য অনেককে অন্ধ ও পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর কোনো আন্দোলনে এত শহিদ ও হতাহতের সাক্ষী হয়নি বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮৫৮ জন শহিদ এবং ১১ হাজার ৫৫১ জন আহতের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে ৫ জুন রায় প্রদান করা হয়। এ রায়ের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন ৬ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিক্ষোভ হয়। ‘সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে’ এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন। এরপর ৯ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।
এরপর ১ থেকে ৪ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র সমাবেশ ও বিক্ষোভ চলতে থাকে। আর ৪ জুলাই ঢাকায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন ৫ ঘণ্টা। এদিন ছাত্র সমাবেশ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ৭ জুলাই রোববার শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ‘বাংলা ব্লকেডে’ স্থবির হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী। এদিন অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা করা হয়।
৮ জুলাই কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং স্থায়ী সমাধানের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করা হয়। সমন্বয়ক কমিটির সদস্য মো. নাহিদ ইসলাম সংস্কার নিয়ে চার দফা দাবির পরিবর্তে একদফা দাবির কথা বলেন। দাবিটি হলো-সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাশ করা। ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়।
১১ জুলাই বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন। এদিন পুলিশের বাধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা। ১২ ও ১৩ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতে থাকে।
১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে।’ একজন সাংবাদিকের আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
২০১৮ সালের আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানান, সেসময় তিনি বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল কোটা বাতিল হলে কী হয় সেটি দেখা। এ সময় বিসিএসে নারীরা বাদ পড়েছেন, ২৩টি জেলার কেউ পুলিশে চাকরি পাননি।
একই দিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
পরে মধ্যরাতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।
রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন। ১৫ জুলাই বেলা ২টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। এরপর দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়। গুলি করতেও দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়। আহত ২৯৭ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ উভয়ই সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। পরের দিন সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকরা। এতে নিহত হন ছয়জন। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ পায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করার ঘোষণা দেন। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচদিন পর ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফেরে। ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। কিন্তু বন্ধ ছিল মেটা প্ল্যাটফরম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। এছাড়া টিকটকও বন্ধ রাখা হয়।
১৮ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় উত্তাল। মোট নিহত হন ২৭ জন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পালটাপালটি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ দলে দলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষের এসব ঘটনা ঘটে। সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
১৯ জুলাই সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা উলটো ৯ দফা দাবি পেশ করেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল : ১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। ২. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ৩. ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহিদ হয়েছেন, ওইসব স্থানের ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে। ৫. যেসব পুলিশ সদস্য গুলি করেছেন এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যেসব সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছেন এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের আটক করে এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার দেখাতে হবে। ৬. দেশব্যাপী যেসব শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহিদ ও আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগ নামের সন্ত্রাসী সংগঠনসহ দলীয় লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে। ৮. অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। ৯. যেসব ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের কোনো ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে তিনদিনে সারা দেশে নিহত হন ১০৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হন ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন এবং শুক্রবার নিহত হন ৫৬ জন। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন ও ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০ জুলাই শনিবার দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ি, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর। এছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শনিবারই নিহত হন ২৬ জন। সব মিলিয়ে চারদিনে নিহত ১৪৮ জন।
২১ জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর অজ্ঞাত স্থান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দফা দাবি পূরণের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলেন। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা, শিক্ষার্থীদের আসার ব্যবস্থা করে দিয়ে হল খুলে দেওয়া, আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কারফিউ তুলে দেওয়া। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন চারজন সমন্বয়ক।
একই দিনে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি’ শিরোনামে একটি খুদে বার্তা গণমাধ্যমকর্মীদের মোবাইল ফোনে পাঠানো হয়। যৌথ বিবৃতিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে হত্যার দায় এড়াতে পারে না সরকার। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ‘তিন শতাধিক’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার অভিযোগ করা হয় বিবৃতিতে। এছাড়া বিবৃতিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এছাড়া সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদারসহ কয়েকজনের সন্ধান দাবি করা হয়।
২২ জুলাই কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। ২৩ জুলাই মঙ্গলবার কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। রাতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। ২৪ জুলাই কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। নিখোঁজ থাকার পাঁচদিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে দুজনই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান। আর রিফাত আত্মগোপনে আছেন। ২৫ জুলাই অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন দিয়ে বলে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন করে বলেন, আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।
২৬ জুলাই শুক্রবার এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দেওয়া হয়। সারা দেশে অভিযান চলে। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা হয়। গ্রেফতারের সংখ্যা ৬ হাজার ২৬৪। চট্টগ্রামে ৩০ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়। নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অপর দুই সমন্বয়ক হলেন আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার। তারা তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একদল ব্যক্তি সাদা পোশাকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ধানমন্ডির ওই হাসপাতাল থেকে তাদের তুলে নিয়ে যায়। সেসময় ওই ব্যক্তিরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেন। সেখানে উপস্থিত এক সমন্বয়কের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ তথ্য জানান।
২৭ জুলাই শনিবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ। এ দুজনকেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্য জানতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে ডিবি জানায়। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের দেখতে যান।
২৮ জুলাই রোববার কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ভোরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন বলে জানায় ডিবি। রাত ৯টার দিকে নাহিদ ইসলামসহ ছয় সমন্বয়কের ওই ভিডিও বার্তা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথক বার্তায় এ আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘অস্ত্রের মুখে ডিবি অফিসে ৬ সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতি নেওয়া হয়েছে। ডিবি অফিস কখনোই ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়।’
মধ্যরাতে ‘সমন্বয়কদের কাছ থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায়, সারা দেশে বিনা বিচারে হত্যা, গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে’ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুক্ত থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক। ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান সমন্বয়করা। এ স্থানগুলো হলো সায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী। এদিন মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর সচল হয়।
২৯ জুলাই সোমবার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয় ১৪ দলের বৈঠকে। ওদিকে ৬ সমন্বয়ক তখনও ডিবি হেফাজতে। সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে পরদিন মঙ্গলবার সারা দেশে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তবে সরকার ঘোষিত মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর বদলে এদিন একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়।
৩০ জুলাই মঙ্গলবার হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতিতে স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙান অনেকে। এসব ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আছেন। অন্যদিকে সরকার সমর্থকদের অনেকে ফেসবুক প্রোফাইলে কালো রঙের ফ্রেম জুড়ে দেন। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে। ৩১ জুলাই বুধবার মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। এই দিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’। সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ের জন্য ডেকে কথা বলতে না দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও স্লোগান দেন। ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেলা দেড়টার একটু পরেই তারা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন।
রাতে ছাড়া পাওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘ছয়দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?’ এদিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
২ আগস্ট শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘দোয়া ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। সারা দেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়া এদিন ছিল শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পীসমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ। ৩ আগস্ট শনিবার সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে রাজধানীসহ দেশজুড়ে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ হয়। ৪ আগস্ট রোববার সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথমদিনে সারা দেশে ১৮ জেলায় ঘটে ব্যাপক সংঘাতের ঘটনা। এদিন ১১৪ জন শহিদ হন।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মৃত্যুর মুখে বীরবিক্রমে স্বৈরশাসকের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অকুতোভয় লাখ লাখ মানুষের বিজয়ের দিন। দিনটি ছিল ৫ আগস্ট বা ‘ছত্রিশে জুলাই’। সোমবার। পদত্যাগ করে দুপুরে হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে স্বৈরাচার পতনের অফিশিয়াল খবর নিশ্চিত করেন। একই সঙ্গে ঘোষণা আসে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের। এরপর জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার আছড়ে পড়ে গণভবন ও সংসদ ভবনে। বাদ যায়নি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরও। পলাতক প্রধানমন্ত্রীর শোবার বিছানা থেকে শুরু করে রান্নাঘর-সর্বত্র ছিল বিক্ষুব্ধ জনতার সরব উপস্থিতি। এভাবে মুক্তিকামী কোটি কোটি জনতা মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আরেকবার স্বাধীনতার স্বাদ অর্জন করে বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। গণ-অভুত্থানের সম্মুখ সারিতে অংশ নেওয়া নতুন প্রজন্মের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় নতুন এক বাংলাদেশের।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত, গণ-অধিকার পরিষদ, যুবদল-ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থনের কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরম তৈরি করেন। একের পর এক কর্মসূচি দেন। আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয় বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনেক। গ্রেফতার করা হয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ আরও অনেক নেতাকর্মীকে। সেই দিনগুলোয় অর্থনৈতিক অসন্তোষ এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ের মাধ্যমে জনগণ একত্রিত হয়, বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের দমানোর জন্য ক্রমবর্ধমান তীব্র ও সহিংস রাষ্ট্রীয় পীড়ন দেখে তারা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশ যখন উত্তাল, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে সব স্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দেন।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করলে পরের দিন সংবাদ সম্মেলন করে কোটা আন্দোলনের দাবির সফল বাস্তবায়নে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে ‘সর্বাত্মকভাবে রাজপথে’ থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
এদিকে এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও। আন্দোলের কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া, সম্বয়কদের পুলিশি গ্রেফতার এড়াতে সেইফ হাউজের ব্যবস্থা করেন। আন্দোলনে মোড় ঘুরানো ঐতিহাসিক নয় দফা প্রণয়নে শিবিরের সাবেক ও বর্তমান নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই ঢাকার সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি ও গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে। পরে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
৪ আগস্ট ছাত্ররা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন ছিল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত প্রতিবাদী জোট গড়ে তোলে। ঘোষণা দেওয়া হয় ৫ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের। ওইদিন ছাত্রদের ডাকে সারা দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা নেমে আসে রাজপথে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, পালিয়ে যেতে বাধ্য হন স্বৈারাচার শেখ হাসিনা। জয় হয় ছাত্র-জনতার। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বিজয়ে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মাঠে থেকে বড় ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনে জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
আরো পড়ুন : টাঙ্গাইলে ভেঙে ফেলা হলো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতার ম্যুরাল