জাতীয় ভোক্তা অধিকার কার্যক্রম উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেই

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আইন-আদালত জনদুর্ভোগ জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি প্রচ্ছদ লাইফ স্টাইল শিল্প প্রতিষ্ঠান হ্যালোআড্ডা

দেশে মোট ভোক্তার অর্ধেকের বেশি বাস করেন গ্রামীণ অঞ্চলে। কিন্তু জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম এখনো মূলত বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক। জেলা পর্যায়ে অধিদপ্তরের কার্যক্রম সীমিত। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত জনবলসংকটের কারণে তাঁরা সেবার পরিসর সেভাবে বাড়াতে পারছেন না। আর অধিদপ্তরের কার্যক্রম কম থাকায় গ্রামীণ পর্যায়ের ভোক্তারাও তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্প জনবল নিয়ে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। গ্রামীণ মানুষকে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে গণমাধ্যমের সাহায্যে প্রচার, লিফলেট বিতরণ ও জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।

ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা ও তাঁদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে আজ মঙ্গলবার পালন করা হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২০০৯ সালে। এটি চলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে। এ আইনে বেশি দামে পণ্য বিক্রি, পণ্যে ভেজাল, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার, ওজনে কারচুপি দণ্ডনীয় অপরাধ।

মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাকে প্রতারিত করলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে অধিদপ্তর।বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে পরিবহন, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, জ্বালানি, গ্যাস-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সঠিক দামে যথাযথ সেবা পাওয়ার অধিকার আছে ভোক্তার। আবার অনলাইনে পণ্য কিনে যথাসময়ে যথাযথ পণ্য না পেলেও ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৬২ শতাংশ লোক এখনো গ্রামে বাস করে। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের আটটি বিভাগীয় শহর ও জেলা পর্যায়ে কার্যালয় আছে অধিদপ্তরের। এসব কার্যালয়ে মোট জনবল ২১৭ জন, যার মধ্যে কর্মকর্তা ৯৬ জন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে তিন থেকে পাঁচজন করে সহকারী পরিচালক, জেলা কার্যালয়ে একজন করে সহকারী পরিচালক ও একজন করে অফিস সহকারী কাজ করেন। উপজেলা পর্যায়ে অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও একজন কর্মকর্তার পক্ষে হাজারো ভোক্তার অধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়।

তদারকি বাজারকেন্দ্রিক: ঢাকা বিভাগের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নিয়মিত বাজার তদারকি ও ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অধিদপ্তর পণ্যে ভেজাল নির্ণয়, বিজ্ঞাপন ও সেবা খাত নিয়ে কাজ করার তেমন সুযোগ পায় না। এ কারণে অধিদপ্তরের কার্যক্রম মূলত বাজারকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত ১৬ দিনে ৬২৫টি অভিযান চালিয়েছে অধিদপ্তর। এর সবই ভোজ্যতেলকেন্দ্রিক। এসব অভিযানে ১ হাজার ৫৪২টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আইন অনুয়ায়ী, পণ্যের পাশাপাশি সেবার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে ক্রেতা বা ভোক্তার। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সীমিত জনবলের কারণে তাঁরা শুধু পণ্যের দাম নিয়েই কাজ করতে পারেন। বিজ্ঞাপন ও সেবা খাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন না। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে অধিদপ্তর।

কারিগরি দক্ষতার অভাব: ভোক্তা কোনো পণ্য বা সেবা কিনে প্রতারিত হলে অধিদপ্তরে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। প্রতিবছর অধিদপ্তরে ভোক্তাদের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। তবে বেশির ভাগ অভিযোগকারীই শহরাঞ্চলের। বিশেষ করে ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে অনলাইন কেনাকাটাকেন্দ্রিক। কিন্তু কারিগরি দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি অপরাধী শনাক্ত করার প্রযুক্তি না থাকায় সব অভিযোগের বিচার করা অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব হয় না।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ১২৪টি অভিযোগ পেয়েছে অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২০১৮ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনলাইন কেনাকাটাভিত্তিক অভিযোগ জমা পড়েছে ২৬ হাজার ৫৩৭টি।বিজ্ঞাপন

অনলাইনকেন্দ্রিক অভিযোগের ধরন থেকে জানা যায়, অনলাইন কেনাকাটার প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরে অভিযোগ রয়েছে ১৬ হাজার ৩০৯টি। এরপরই রয়েছে ফেসবুক পেজভিত্তিক পণ্য কেনাবেচার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ৫ হাজার ৪৭টি।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ফেসবুককেন্দ্রিক অভিযোগগুলো মূলত সঠিক পণ্য না দেওয়া, যথাসময়ে পণ্যের ডেলিভারি না দেওয়া, টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়াসংক্রান্ত।

অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফেসবুক পেজে পণ্য কিনতে গিয়ে কেউ অগ্রিম টাকা দিলেন, কিন্তু কয়েক দিন পর দেখলেন, সেই পেজ আর নেই। এমন বিষয়ে অভিযোগ এলে আমাদের পক্ষে প্রতারককে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না। কারণ, সেই প্রযুক্তি আমাদের নেই। তখন সিআইডির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

চোখের দেখায় ভেজাল নিরূপণ: কোনো পণ্যে রাসায়নিক বা ভেজাল মেশানো হচ্ছে কি না, সেটি দেখার এখতিয়ারও অধিদপ্তরের আছে। কিন্তু ভেজাল নিরূপণে অধিদপ্তরের নিজস্ব কোনো গবেষণাগার নেই।

অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, অভিযানে গেলে পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে পণ্যে ভেজালের বিষয়টি তাঁরা নির্ণয় করেন। পরীক্ষার সুযোগ তাঁদের নেই।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে অধিদপ্তরের নিজস্ব গবেষণাগারের কথা বলা আছে। কিন্তু এখনো সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গবেষণা করার মতো টেকনিক্যাল লোক নেই। গবেষণাগার থাকলে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা অধিদপ্তরের পক্ষে সহজ হতো।’

সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে ভোক্তা অধিকারের কার্যপরিধি উল্লেখ আছে। আর পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে অধিদপ্তরের নানা সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও আমরা চাইব, অধিদপ্তর সুষ্ঠুভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে। ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করবে।’

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *