জেনে নিন; আপনার শিশুর জীবন বিনাশের কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা

জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ ভ্রমণ লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

ঘর থেকে বেরোনোর পর আপনার যে কোনো প্রয়োজনে অথবা শিশুকে স্কুলে নেওয়ার জন্য যে যানটি ব্যবহার করছেন, সেটি যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা হয়, তবে জেনে রাখুন, এ ভয়ংকর বাহনটি নীরবে আপনার শিশুর জীবন বিনাশের কারণ হয়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকা এই ঝুঁকিপূর্ণ তিন চাকার গাড়িটিতে যে লেড অ্যাসিড ব্যাটারি ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষতিকর সিসা বিভিন্নভাবে মিশে যাচ্ছে পরিবেশে। মাটির বিষ খাদ্যের সঙ্গে মিশে মানবদেহে মারণব্যাধি ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন দেশের ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য আমদানি নীতিতে পুরনো ব্যাটারি আমদানির সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ এসেছে। তবে সেই সুপারিশে আপত্তি জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ-সংক্রান্ত এক চিঠিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলেছে, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত লেড অ্যাসিড ব্যাটারির পরিবেশসম্মত রিসাইক্লিং নিশ্চিত করা যায়নি। এ অবস্থায় পুরনো লেড অ্যাসিড ব্যাটারি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলে দেশে ব্যবহৃত লেড অ্যাসিড ব্যাটারির পরিবেশসম্মত রিসাইক্লিং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এ লেড পরিবেশের মাটি, পানি, বায়ুর দূষণ ঘটাবে। তাই আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২০২৪-এর ধারা ২১(১৬)-এর বিধানে ব্যাটারি রিসাইক্লিং করার লক্ষ্যে পুরনো ব্যাটারি আমদানির অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাজেদুল ইসলাম এ চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও বিধিতে পুরনো লেড ব্যাটারি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সে বিষয়টিই জানিয়ে দিয়েছি। আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআরের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু বাংলাদেশেই সাড়ে ৩ কোটি শিশুর রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় সিসা আছে বা তারা সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ দেশের শতভাগ শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে। ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই)-এর মতে, সিসার কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বিশ্বে চতুর্থ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, সিসা দূষণের কারণে বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে, যার মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় তুলনামূলকভাবে মৃত্যুহার ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। সে কারণে পরিবেশবাদীরা সিসাকে ‘নীরব ঘাতক’ হিসেব চিহ্নিত করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এ নীরব ঘাতক সিসা বাংলাদেশের মাটি, পানি, বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, স্বল্পমূল্যের ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের ব্যবহার সারা দেশে শুধু পরিবেশের ক্ষতি করছে তা-ই নয়, যত্রতত্র দাঁড়িয়ে থাকা এবং যে কোনো রাস্তায় এর ব্যবহার সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়া-মহল্লার রাস্তা থেকে এসব রিকশা ও ইজিবাইক কখনো কখনো বড় রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। ফলে দ্রুতগতির যানের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও জেলা ও উপজেলা শহরের সরু রাস্তায় অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক যানজট তৈরি করছে। এমনকি এসব বাহনের কারণে পথচারীরাও পথে যেতে সমস্যায় পড়ছেন। উপরন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ সংরক্ষিত এলাকায় এ যানের মাত্রাতিরিক্ত কর্কশ হুইসেল শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে। ২০২১ সালে অবৈধ ব্যাটারিচালিত সব ইজিবাইক চিহ্নিত করে অপসারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। এর পরও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ ইজিবাইক আমদানি; পাশাপাশি বেড়েছে দেশে তৈরি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহার। বাড়তে থাকা এ ইজিবাইক ও রিকশা চালাতে লেড অ্যাসিড ব্যাটারির ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় সব লেড অ্যাসিড ব্যাটারিই পুরনো ব্যাটারি রিসাইক্লিং করে এবং ফেলে দেওয়া ধাতু থেকে তৈরি করা হয়। পুরনো ব্যাটারিগুলো গলিয়ে অশোধিত সিসা পাওয়া যায়, যা নতুন ব্যাটারি তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে কারণে উন্নত দেশের গাড়িতে ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার অপ্রাতিষ্ঠানিক সিসা কারখানাগুলোয় বিভিন্নভাবে চলে আসছে; যা এ অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মক দূষণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ব্যাটারি তৈরির কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশ আবার শিশু।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন প্রায় ২০ বছর কাজ করেছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে। তারা দেখেছে শ্রমজীবী শিশুর একটা বড় অংশ কাজ করে পুরনো সিসা অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিংয়ের গ্যারেজে। এ রিসাইক্লিং খাতে এক চতুর্থাংশই শিশু শ্রমিক। সংস্থাটির সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা রঞ্জনা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের কারণে বাংলাদেশে সিসাদূষণ বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়ছে। এটি পরিবেশ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি বলেন, দেশে আইন থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায়, অননুমোদিত স্থানে কোনোরকম সুরক্ষা কিংবা সতর্কতা ছাড়াই ব্যবহৃত পুরনো লেড অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং করে সিসা গলানো হচ্ছে। ফলে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া সঠিক ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা এবং সচেতনতার অভাবে ব্যবহৃত ব্যাটারি নষ্ট হওয়ার পর সেগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সেই সিসা পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে বায়ু, পানি, মাটিতে বিষ ছড়াচ্ছে। এ বিষের প্রভাবে আমাদের শিশুরা হাঁচি, শুকনো কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, তলপেটে ব্যথা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচিসহ নানা অসুখে ভুগছে। এমনকি ক্ষতিকর সিসার প্রভাবে অনেক শিশুর স্মৃতিশক্তিও কমে যাচ্ছে। বড়রাও এ ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়।

আরো পড়ুন : উন্নত দেশে বাড়ি ও সম্পত্তি কেনার উৎসব চলছে বাংলাদেশিদের

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *