দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। সোমবার কমিশন জানিয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ভোটগ্রহণ হবে সনাতনী ব্যালট পেপার আর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে। ইভিএম মেরামতের জন্য অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়া, সময় স্বল্পতা ও ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা থাকায় নির্বাচনের সাত মাস আগে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে ইসি’র সিদ্ধান্তের পেছনে আরও কিছু কারণ আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনার এটি একটি প্রক্রিয়া হতে পারে। এ ছাড়া বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পরামর্শও এক্ষেত্রে কাজ করে থাকতে পারে। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আগেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এতদিন অহেতুক বিতর্কের অবতারণা হতো না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ইভিএম থেকে সরে এসেছে। মূল বিষয় হলো তাদের কাছে টাকা নাই। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা গুরুত্ব পায়নি।
তাদের কাছে টাকা থাকলে ঠিকই ইভিএম ব্যবহার করতো। তিনি বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনা নয় বরং ইভিএম বাতিল করে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার কৌশলও হতে পারে। এখন নির্বাচন কমিশন বলবে তারা তো চেয়েছিল ব্যালটে ভোট করতে; এখন সেটি তো করা হলো, তাহলে তারা আসে না কেন? তিনি আরও বলেন, এখন তারা সংলাপে ডাকছে, ব্যালটে নির্বাচন দিচ্ছে, এটা হলো নির্বাচন ম্যানেজমেন্ট কৌশল। কিন্তু মূল পলিটিক্যাল ইস্যুর সমাধান না করলে এটি কাজে আসবে না। এটি করলে একতরফা হবে। আমি খুব একটা আশার আলো দেখি না। ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল বিষয়টি আসলে ইভিএম বা ব্যালট না। বিষয়টি হলো নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারছেন না। সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারছেন না। একটি দল ভোট বুথ সব সময় দখল করে রাখছে। ভোট বুথ দখল থাকলে ইভিএম দিলেও যেমন ভোট হবে, ব্যালটে দিলেও তাই হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ইভিএম নিয়ে যেন আর বিতর্ক না হয় সেটি থেকে সরে আসার জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, বর্তমানে অর্থ সংকট রয়েছে। সেই সঙ্গে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ বিরোধিতা করে আসছে। এই মুহূর্তে ইভিএমের পেছনে টাকা খরচ করলে দেশের মানুষ তাদের প্রতি আরও বিরক্ত হতো। এটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ ছাড়া তারা এখন ভীষণ চাপের মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, আমি জানি না, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা আসছে কিনা। কারণ তারা যদি আবারো ওইরকম নির্বাচন করে তাহলে পার পাওয়া দুরূহ হবে। এই জায়গা থেকে তারা এমন করছে কিনা। কেনিয়ার নির্বাচনের সঙ্গে জড়িতদেরকে স্যাংশন দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ রকম ঝুঁকিতে তারাও আছে। এটাও একটি কারণ হতে পারে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি প্রথম থেকেই জানতাম তারা ইভিএমে ভোট করতে পারবে না। এটাই হওয়ার ছিল। অধিকাংশ মানুষই ইভিএম চায় না। তারা এতদিন কেন যে ইভিএম নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলো; এত কথা বললো, বিতর্ক হলো-সেটি বলতে পারবো না। এখন তাদের ভাবতে হবে আগামী নির্বাচন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ইভিএমের পেছনে খরচ করা হলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেতো। এ ছাড়া ইভিএমে ভোটের হার কম হচ্ছে। ভোট দিতে অনেক সময় লাগছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তো যাচাই করা যায় না। নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে এসে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমি মনে করি।
ব্যালটেই ভোট: আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনেই আর ইভিএম ব্যবহার করা হবে না, ৩০০ আসনের সবগুলোতেই ভোটগ্রহণ হবে সনাতনী ব্যালট পেপার আর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে। সোমবার ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সভা শেষে কমিশনের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমানও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনে ব্যালট পেপার এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে বলে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ মেশিন মেরামতের জন্য যে ১২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল; এ অর্থ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার কারণে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হবে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে বলে জানান ইসি সচিব।
আরো পড়ুন : আইপি টিভিতে সংবাদ প্রচার বন্ধে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ