জেনে নিন ভাড়াটে সেনা দিয়ে রাশিয়া কিভাবে আফ্রিকা লুটছে

আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদ মুক্তমত

আলেসান্দ্রো আরদিউনো :- বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধ থেকেই আফ্রিকা মহাদেশে ভাড়াটে বাহিনী সেখানকার রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য শক্তি হয়ে আছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে কিংবা সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নতুন কোনো নেতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভাড়াটে বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। একসময় আফ্রিকার দেশগুলোয় ভাড়াটে বাহিনীতে নাম লেখানোর পূর্বশর্ত ছিল তার মালিকানায় অস্ত্র থাকতে হবে। দশকের পর দশক ধরে এটিই অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে কাজ করে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ভাড়াটে বাহিনীর বিবর্তন হচ্ছে। কারিগরি উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সম্মুখসারির যোদ্ধা, সব ক্ষেত্রেই সেটা ঘটছে।

অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর অনেক দেশে ভাড়াটে বাহিনী পররাষ্ট্র নীতির অংশ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়া, সুদান, মোজাম্বিক, মালি, সেন্টাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো-আফ্রিকা মহাদেশের এসব দেশে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। বিনিময়ে লাভজনক প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে নানা চুক্তির পাশাপাশি ও বিমানবন্দর করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাশিয়াকে।

১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে শীতল যুদ্ধ শুরুকালে রাশিয়া প্রথম আফ্রিকায় তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। পশ্চিম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলো তখন পক্ষ বেছে নিতে শুরু করেছিল। আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন এবং সেখানকার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে মুনাফা লুটে নেওয়ার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে রাশিয়া। অতিসম্প্রতি আফ্রিকায় রাশিয়ার যে কৌশলগত অবস্থান, তার মূলে রয়েছে মুনাফা। এর সঙ্গে মতাদর্শ কিংবা নীতিনৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। ইউক্রেন যুদ্ধে বেকায়দায় পড়ার পর ওয়াগনার গ্রুপের মতো ভাড়াটে সেনাদের কোম্পানি আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধিতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

আফ্রিকায় ওয়াগনার গ্রুপের কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে এসব পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ওয়াগনার গ্রুপকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। রাশিয়ার ভাড়াটে সেনারা আফ্রিকায় তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেই চলেছে।

ভ্লাদিমির পুতিনের প্রেসিডেন্সিকালে (১৯৯৯-২০০৮ ও ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত) রাশিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক কোম্পানি ও ভাড়াটে সেনারা দেশটির পররাষ্ট্র নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আফ্রিকায় ওয়াগনার গ্রুপ এমন একটি উর্বর পরিবেশ পেয়েছে যে তারা খুব সহজেই সেখানে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে। সাত বছর ধরে আমি আফ্রিকায় চীনা ব্যক্তিমালিকানাধীন নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছি। এ সময়ে আমি আফ্রিকায় রাশিয়া ও তুরস্কের ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক ও ভাড়াটে কোম্পানিগুলোর বিবর্তনের একটা পথরেখাও পেয়েছি। আমার বিবেচনায় ওয়াগনার গ্রুপ আফ্রিকার প্রভাবশালী নেতাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মহাদেশটিতে মস্কোর ভূরাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে।

ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনারা বড় প্রকল্পগুলো সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংকটে পড়া সরকারগুলোকেও নিরাপত্তা দেয়। বেসামরিক মানুষ হতাহত হলেও সেটা তারা বিবেচনায় নিচ্ছে না। ফলে পুরো মহাদেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে।

ওয়াগনার গ্রুপ কী?

২০১২ সালে ভ্লাদিমির পুতিন পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির আইনসভার কোনো ধরনের তদারকি ছাড়াই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে সামরিক ও গোয়েন্দা আমলাতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কই প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। পুতিনকে ঘিরে থাকা প্রভাবশালীরা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে আধা সামরিক বাহিনী ও ভাড়াটে সেনাদল গড়ে তোলার সুযোগ পেয়ে যায়।

ধারণা করা হয় যে রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল দিমিত্রি উটকিন ওয়াগনার গ্রুপ গড়ে তোলেন। যদিও ভাড়াটে বাহিনীটির উদ্ভবের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া আগ্রাসন শুরু করলে ওয়াগনার গ্রুপের নাম প্রথম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।

ধারণা করা হয়, ওয়াগনার গ্রুপে অর্থায়ন করেছেন ইয়েভগেনি প্রিগোসিন। বিখ্যাত ক্যাটারিং ব্যবসায়ী থেকে কুখ্যাত কমান্ডারে পরিণত হয়েছেন তিনি। রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্র ক্রেমলিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকার বিষয়টি প্রথম কয়েক বছর ওয়াগনার গ্রুপ অস্বীকার করেছিল। যাহোক, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি শেয়ার করে ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি খোলাসা করেন প্রিগোসিন।

সামরিক প্রতারণায় ক্রেমলিনের বিশাল অনুরাগ রয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রিগোসিন এই গল্পে অন্যতম প্রধান নায়ক হয়ে উঠেছেন। তবে ওয়াগনার গ্রুপের মূলে প্রিগোসিন রয়েছেন, সেটা ভাবা অনুচিত হবে। সের্গেই সুখানিন রাশিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক কোম্পানিগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি লিখেছেন, প্রিগোসিন একজন অলিগার্ক নন। ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি সেনাবাহিনী গঠন করার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই।

ওয়াগনার গ্রুপ কেন আফ্রিকায়

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র সক্ষমতা কম থাকায় মালি থেকে সুদান, সবখানেই ওয়াগনার গ্রুপ নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এবং ব্যাপক মুনাফা লুটে চলেছে। ২০১৭ সালে সুদানে ওয়াগনার গ্রুপ সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে নিরাপত্তা ও সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। এর বিনিময়ে রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা নামমাত্র বিনিয়োগে সেখানকার হীরার খনির ব্যবসা পেয়ে যায়।

হীরা ও সোনাসমৃদ্ধ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টান্ত দেখা যায়। ২০১৭ সালে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধে সরকারকে সহায়তা করে ওয়াগনার গ্রুপ। বিনিময়ে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ান উপদেষ্টারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়।

গ্যাসসমৃদ্ধ মোজাম্বিকে ওয়াগনার গ্রুপ দেশটির সরকারি বাহিনীকে উত্তরাঞ্চলে বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। ২০১৯ সালে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে বাহিনী নিয়োগের কয়েক মাস আগেই মোজাম্বিকের সঙ্গে খনিজ সম্পদ, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতে চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া।

২০২১ সালে সাহেল অঞ্চলের চরমপন্থীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য মালি ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সেটা নিশ্চিত করেন। কিন্তু বেসামরিক জনগণের ওপর ওয়াগনার গ্রুপের সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভাড়াটে বাহিনীর হাতে কয়েক শ বেসামরিক নাগরিক নিহতের অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা তদন্তের দাবি জানিয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াগনার গ্রুপকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে।

আফ্রিকায় ওয়াগনার গ্রুপের কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে এসব পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ওয়াগনার গ্রুপকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। রাশিয়ার ভাড়াটে সেনারা আফ্রিকায় তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেই চলেছে।

আলেসান্দ্রো আরদিউনো প্রভাষক, কিংস কলেজ, লন্ডন
সুত্র: এশিয়া টাইমস

আরো পড়ুন : ডলারের কারণে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ডিম-মুরগির বাজার

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *