ডলারের বাজারে শিগগিরই স্থিতিশীলতা আসছে না। শেষ হচ্ছে না সংকট। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের ব্যবসায়ী মহল। ডলার সংকট কাটাতে অর্থ পাচার বন্ধ ও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রপ্তানি আয়ের অর্থ ঠিকমতো দেশে আসছে কি না-সেখানে আরও কড়া নজরদারি প্রয়োজন। প্রয়োজনে নীতি বা আইন-কানুনের পরিবর্তন করারও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। অবশ্য সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর নীতি অবলম্বনের নির্দেশনা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। একই সঙ্গে দেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালের মার্চে শুরু হওয়া ডলার সংকট দিন দিন বেড়েছে। গত বছরে ভয়াবহ রূপ নেয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। আমদানিকারকরা চাহিদামতো ডলার পাননি। ন্যায্য দাম পাননি রপ্তানিকারকরাও। ৮৫ টাকার ডলার খোলা বাজারে ১৩০ টাকার কাছাকাছি চলে আসে। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের চেষ্টা করার পরও বাস্তব অর্থে তার কোনো ফল পাওয়া যায়নি। গত বছরজুড়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ ধরে রাখা নিয়ে চাপে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের ঋণের শর্ত ছিল, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নেট রিজার্ভ থাকতে হবে। সেটাও সম্ভব হয়নি। কারণ, সারা বছরই প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তাতে নেট রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে চলমান টানা ডলার সংকটের অন্যতম কারণ অর্থ পাচার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির হিসাব মতে, রপ্তানির একটা বিরাট অংশ দেশে আসে না। একইভাবে প্রচুর ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে বেআইনিভাবে টাকা পাচার করে নামে-বেনামে দেশের বাইরে সম্পদ গড়ে তুলছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী।
অর্থ পাচার রোধে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে না পারলে পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর কোনো দেশের সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করাও অসম্ভব। সংস্থাটি গত মাসের মাঝামাঝিতে বিদায়ী ২০২৩ বছরের কর্মকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে জিএফআই। অন্যথায় সংস্থাটির সঙ্গে চলমান ঋণ প্রকল্পের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় আটকেও যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাচার বন্ধে কঠোরতা দেখাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর কিছু নীতি পলিসিতেও পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে দেদার। ইতোমধ্যে পাচারকারী কিছু ব্যক্তির নামও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। এগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়ার প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। এদিকে প্রায় দেড় বছর আগে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। যদিও সেটা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। সম্প্রতি আর্থিক খাতের শুদ্ধতার জন্য অভিযান শুরু করে সিঙ্গাপুর, কানাডা, কাতার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ। এতে বেশকিছু সম্পদ ও অর্থ পাচারকারীকে আটক করা হয়। সে সময় বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীদেরও নানা রকম তথ্য প্রকাশ পায়। এটাকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে একটি কৌশলপত্রও তৈরি করা হয়। তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া অর্থ ফেরত আনা কঠিন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতা এসেছে। এখন সরকার চাইলে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু-সরকার এর জন্য আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
আরো পড়ুন : কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক কমছে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি