স্বপ্নার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। একমাত্র সন্তান অয়নকে কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ডেঙ্গু সরব ঘাতক। অথচ কর্তৃপক্ষ নীরব। শুধু স্বপ্না নন, এমন বহু মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন। ডেঙ্গুর ভয়াল থাবায় বহু সংসারে এখন শুধুই হাহাকার। চলতি বছর ডেঙ্গুতে শিশু ও নারীদের কাবু করেছে বেশি। বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। আর ভয়ঙ্কর রূপ নেয় জুলাইতে। ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে সাড়ে ১১০০ জনের।
এর মধ্যে শিশু ও নারীই বেশি। আক্রান্তের শীর্ষে পুরুষরা হলেও মৃত্যুতে নারীদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। মোট মৃত্যুর ৫৭ শতাংশই নারী। আর শিশুদের মৃত্যুর হার প্রায় ১৫ শতাংশ। ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে। এরমধ্যে পুরুষ ৬০ শতাংশের উপরে। নারী রয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ, শিশুরা ১৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। সামনে এ পরিস্থিতি কতদিন চলবে তারও কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। বর্তমান রোগীর চেয়ে আরও ১০ গুণ বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই।
দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যু ও শনাক্তে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি গ্রামে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১২ই অক্টোবরের হিসাব মতে, মোট মৃত্যুর শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ঢাকাতে এবং শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ঢাকার বাইরে। মোট আক্রান্তের মধ্যে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেছে। নারীদের মৃত্যুর হার ৫৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ (৬৪২ জন), শিশুরা ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ (১৬৭ জন), পুরুষদের মৃত্যুর হার ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ (৪৯৩ জন)। শিশুদের আক্রান্তের সংখ্যা ৪১ হাজার ৯৬৫ জন। আক্রান্তের হার ১৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। নারীর আক্রান্তের হার ৩৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ (৯২ লাখ ৩৯৪ জন), পুরুষের আক্রান্তের হার ৬০ দশমিক ৪৩ শতাংশ (১ লাখ ৪১ হাজার ১৩৭ জন) রয়েছেন। ঢাকা সিটিতে শিশুদের আক্রান্তের হার ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ (২১ হাজার ৯০০ জন)। ঢাকার বাইরে শিশুদের আক্রান্তের হার ১৪ শতাংশের কিছু বেশি।
ডেঙ্গু রোগী কমছে না কেন- জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের বাহন হচ্ছে এডিস মশা। এই মশা আগে ঢাকা ও ”ট্টগ্রামের মতো বড় সিটিতে বেশি ছিল। কম হোক, বেশি হোক মশা মারার জন্য এসব সিটিতে ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু এখন সারা দেশে এডিস মশা ছড়িয়েছে। ফলে সারা দেশ থেকে ডেঙ্গু জ্বরের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। রোগী যেখানে বেশি পাওয়া যাবে মৃত্যুও সেখানে বেশি হবে। জেলা শহর বা উপজেলা পর্যায়ে মশা মারার উদ্যোগ দেখছি না। ফলে রোগী কমছে না।
কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, চলতি মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন কমিউনিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন, জুলাইয়ে গিয়ে আমরা ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পেলাম। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে যায়। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দেয়া হয়, তার চেয়ে ১০ গুণ রোগী বেশি হবে। ২০২১ সালে দেখেছি অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এরপর পরবর্তী বছরে দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরে জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০-এর মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশার নিধন করতে হবে। এডিস মশা যেখানে হয় সেখানে টার্গেট করে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছরে মে মাসের শেষদিক থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। তা এখনও বলবৎ রয়েছে।
ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ১৩ জনের মৃত্যু: ডেঙ্গুতে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এই নিয়ে ডেঙ্গুতে এবছরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৪৮ জনে। একদিনে আরও ১ হাজার ৬৭৩ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৫ হাজার ২০৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৯১ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৬ জন। মৃত ১ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে নারী ৬৫১ জন এবং পুরুষ ৪৯৭ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৪৩১ জন এবং রাজধানীতে ৭১৭ জন।
ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৬৭৩ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৭৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৯৫ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ১ হাজার ৬৭৩ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৪৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৫৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৭১০ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৫ হাজার ২০৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ১ লাখ ৪২ হাজার ১০০ জন এবং নারী ৯৩ হাজার ১০৪ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ২৫ হাজার ৮০৮ জন।
আরো পড়ুন : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, রোববারের নামাজের সময়সূচি