দেশে দ্রুত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ২৮ জন। রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগী বেশি আসছে হাসপাতালগুলোতে। এই সিটির কর্তৃপক্ষ ৩টি ওয়ার্ডকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ঢাকা মহানগরীর পর দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী কক্সবাজারে। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে।
দক্ষিণ সিটিতে কেন ডেঙ্গু রোগী বেশি জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির মানবজমিনকে বলেন, দক্ষিণ সিটি বড় এলাকা। এটি ঘনবসতিপূর্ণ।
তবে যে পরিমাণে এই সিটিতে ডেঙ্গু রোগী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেখানো হচ্ছে সেই পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী নেই এখানে। তিনি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, তাদের সিটিতে দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলো রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষ ঢাকায় আসেন। বিশেষ করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে মানুষের কাছে সুপরিচিত। তাই এখানে রোগী আসছে বেশি। তিনি বলেন, ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসে। এসব রোগীরা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তাদের কোনো না কোনো আত্মীয়ের ঠিকানা ব্যবহার করে। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, তারা অনুমান করেছিলেন এবার ডেঙ্গু রোগী বাড়বে। তাই জানুয়ারি থেকেই সব ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছেন। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্মসূচি পালন করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকেও বলা হয়েছে। যার যার জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে সমস্যা হয় না।
মানুষকে সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একার দায়িত্ব নয়। এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭১টিতে তেমন কোনো রোগী নেই। ঘুরে ফিরে ওয়ার্ড নম্বব ৫২ (যাত্রাবাড়ীর একাংশ), ৫৩ (জুরাইন) এবং ওয়ার্ড নম্বর ৬২ (কাজলা) ঝুঁকিপূর্ণ। এই ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বেশি। তাই সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে এসব ওয়ার্ডে। এই বছর ডেঙ্গুর বিষয়ে কোনো জরিপ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গু মৌসুমের পূর্বে বা প্রি-মৌসুম কোনো সার্ভে এখন পর্যন্ত করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে তারা সর্বত্র সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। আগামী সপ্তাহ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন তারা। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্টের অভিযান চলবে। যে বাড়িতে এডিস মশার লার্র্ভা পাওয়া যাবে জেল বা জরিমানা করা হতে পারে। জ¦র হলে ফার্মেসিতে না গিয়ে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শও দেন এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
এদিকে, সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২০১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০৬ জনে। একদিনে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। জুন মাসের দু’সপ্তাহে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২০১ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৭৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৬ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২০১ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০৬ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৬৬৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৩৯ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০২ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ হাজার ৯৬৮ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন।
মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ১ হাজার ৭৮০ জন এবং মারা গেছেন ১৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবছর এখন পর্যন্ত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৩৯ জন। এরপরেই রয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (মিটফোর্ড) ৩৭৩ জন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৭৪ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১৮ জন ভর্তি হন এবার। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭০ জন। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৩ জন ডেঙ্গু রোগী। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আজগর আলী হাসপাতালে ১২৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে চিকিৎসারত আছেন ৩১ জন। মুগদা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ১২৫ জন ভর্তি হয়েছেন এখন পর্যন্ত। চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩০ জন। সালাউদ্দিন হাসপাতালে ৯৪ জন ভর্তি হন এবছর। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৮ জন। সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৬৭ জন ভর্তি হন চলতি বছরে। বর্তমানে ১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালটিতে। কল্যাণপুর ও ধানম-ি ইবনে সিনা হাসপাতালে ৭৭ জন ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসা নিচ্ছেন ২২ জন। হলি ফ্যামিলি অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৪০ জন ভর্তি হন। বর্তমানে চিকিৎসারত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা (অন্য বছরের এ সময়ের তুলনায়) বেশ কয়েকগুণ বেশি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি। সেজন্য আমরা মনে করি আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। সেটি আমরা এরই মধ্যে শুরু করেছি। আমরা দেশবাসীকে এজন্য সচেতন করতে চাই, যাতে সবাই এই মৌসুমে নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি ও সতর্কতা মেনে চলি।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। কেন এবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আগেই বাড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা অব্যাহত থাকে। ফলে ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে এসেও রোগী থেকে যায়। তিনি বলেন, ঢাকায় সব সময়ে নির্মাণকাজ চলে। ফলে বাসাবাড়িতে পানি জমে থাকছে। তাতে এডিসের লার্ভা হচ্ছে। এটি বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অন্যদিকে এবছর মে মাসে বৃষ্টি হয়েছে। এজন্য এডিস মশার বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। এখন গ্রামেও নগরায়ন হচ্ছে। ফলে শহর থেকে জেলা শহর বা উপজেলায়ও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে এজন্য জেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সমন্বিতভাবে ডেঙ্গুকে মোকাবিলা করতে হবে। একার পক্ষে তা সম্ভব না।
আরো পড়ুন : পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে টাকা নিয়ে টানাপড়েনের কারণে মা-মেয়ে খুন