ডেঙ্গুর এখন আর কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম নেই। সারা বছরই ডেঙ্গু বিদ্যমান থাকছে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে নভেম্বর মাসের ১৭ দিনে মারা গেছেন ১৯১ জন। দেশে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩৯ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ লাখ ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি গ্রামে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই
দেশে ডেঙ্গুর মৌসুম কি শেষ হচ্ছে না- জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরেই দেখা যাবে।
আগে নির্দিষ্ট একটা সময় ডেঙ্গু দেখা যেতো। গত বছর থেকে ডেঙ্গু রোগী সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে। কারণ হিসেবে বললেন, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। শহরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থাকলেও গ্রামে কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেই। তাছাড়া গ্রামে এই বিষয়ে সচেতনতা নেই। ফলে এখন এডিস মশা শহরে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গ্রামে আক্রান্ত অনেক বেশি। মৃত্যুও সেখানে বেড়ে গেছে। ঢাকার বাইরে রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। ফলে মৃত্যু বেশি। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ডেঙ্গুর এনএসআই পজিটিভ হলেই ওই রোগীকে পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ড সৃষ্টি করে রেখে দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর এখন আর নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। সারা বছরই ডেঙ্গু বিদ্যমান থাকছে। জলবায়ুগত কারণে এডিস মশা বংশ বিস্তারের সুবিধা পাচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে নগরায়ণ। অপরিকল্পতি নগরায়ণের কারণে নির্মিত ভবনে পানি জমে থাকার ফলে এডিস মশার ডিম পাড়তে সুবিধা হয়। তিনি বলেন, এখন গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। মারাও যাচ্ছে বেশি। গ্রামের মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে তেমন সচেতন না। সেভাবে ওভাবে মশা নিয়ন্ত্রণেরও কার্যক্রম নেই। ডেঙ্গু নিয়ে শহরের মানুষ সচেতন ও শহরে কম-বেশি হলেও মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম চলমান। ফলে ঢাকা শহরে মশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তিনি বলেন, এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাংলাদেশে ইতিহাস ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, প্রতি বছরের ডেঙ্গু জ্বরের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এবার লক্ষ্য করছি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এর পেছনে কারণ কী? আমরা যদি একটু পেছনের লক্ষ্য করি দেখবো, ফিল্ড লেভেলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত ডেঙ্গু হয়েছে, দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দু’টি মাসের একটি মাসে ডেঙ্গু পিক ছিল। ২০২১ সালে দেখেছি অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এরপর দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরে জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশার নিধন করতে হবে।
এতদিন আমরা মশার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে চেপে ধরেছি। কিন্তু এখন আমরা দেখছি সারা দেশে মশা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের উপশহর, উপজেলাতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। কেউ জানে না কেন উপজেলাতে ডেঙ্গু হচ্ছে। সে গবেষণাটা কে করবে, সে গবেষণার ফাইন্ডিং কে দেবে সেটি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এটা ভাবলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাকে আরও জোরদার করবে বলে জানান কবিরুল বাশার।
একদিনে আরও ১১ জনের মৃত্যু: গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে এ বছরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩৯ জনে। একদিনে আরও ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যু ও শনাক্তে পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি গ্রামে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ১ লাখ ৫ হাজার ৮৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬৬ জন। মৃত ১ হাজার ৫৩৯ জনের মধ্যে নারী ৮৭৮ জন এবং পুরুষ ৬৬১ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৬৪১ জন এবং রাজধানীতে ৮৯৮ জন।
ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৫৬ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২০৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭৫০ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৯৫৬ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৪৫ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৩৪৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ৯০০ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৭৭ জন এবং নারী ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৭৩ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ৯২ হাজার ২২৬ জন।
আরো পড়ুন : বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকারের পক্ষে এক প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর করেলেন জো বাইডেন