তাৎক্ষণিক লোন বা ঋণ পাওয়ার অ্যাপের কারণে ভারত এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে বিপুল পরিমাণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ভয়াবহতার এক ফাঁদে পড়ছেন। ঋণের কিস্তি দিতে বিলম্ব হলে অথবা কিস্তি এবং ঋণ পরিশোধ হয়ে গেলেও তাদের অনেকের নগ্ন ছবি আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করছে। এর ফলে অনেক নারী ও পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন অথবা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ঋণ দেয়ার সময় গ্রহীতার মোবাইলের সব কন্টাক্ট শেয়ার করতে হয়। ফলে কম্পিউটারে কারসাজি করা অথবা গোপনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছবি তুলে বা তার গ্যালারি ব্যবহার করে নগ্ন ছবি পাঠিয়ে দেয়া হয় ওইসব ফোন নম্বরে। এমন লোন অ্যাপ চালু আছে ভারত, মেক্সিকো, কলম্বোসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে ‘লোন পরবর্তী সার্ভিসের’ জন্য কোনো কোনো কোম্পানি প্রস্তুত করেছে কমপক্ষে ৩০০০ স্টাফ। বিবিসি’র দীর্ঘ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ভারতসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলতে তাৎক্ষণিকভাবে লোন দেয়ার অ্যাপ চালু করেছে ব্ল্যাকমেইল করা কিছু গ্রুপ। এর ফাঁদে পা দিয়ে নির্যাতিত ও হুমকি পাওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে কমপক্ষে ৬০ জন ভারতীয়। ভারতে এবং চীনে এই ফাঁদ নিয়ে ওই তদন্ত করা হয়।
এমনই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন মুম্বইভিত্তিক প্রপার্টি বিষয়ক সম্মানিত একজন মা, ভীতিহীন একজন বিধবা ভূমি সিনহা। তিনি একা একা ১৭ বছরের মেয়ে আস্থা সিনহাকে বড় করেছেন। সম্প্রতি তার নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়ার কারণে আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা নেন। এ বিষয়টি আস্থা সিনহার কানে তোলেন তার এক আন্টি। সে মায়ের কাছে গিয়ে দেখতে পায়, ভূমি সিনহা অঝোরে কাঁদছেন। হতাশায় আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন। আস্থা বুঝতে পারে এ সময়ে তার কী করতে হবে। হাতের লাঠি হয়ে মাকে এ পথ থেকে ফেরায় সে। তাকে লড়াই করে টিকে থাকার মন্ত্র শিখায়। সে জানতে পারে তার মা উদ্ভট কিছু ফোনকল পেয়েছেন। তিনি কিছু মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। তবে তার কোনো ধারণা ছিল না যে, তার মা মাসের পর মাস ধরে হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ভূমি সিনহা তাৎক্ষণিক লোন পাওয়ার অ্যাপসের ফাঁদে পড়েছিলেন। বর্তমানে কমপক্ষে ১৪টি দেশে এমন অ্যাপ চালু আছে। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারকরা অর্থ বানাচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ খাতে ব্যবসার মডেলটা খুব নিষ্ঠুর। তবে সরল। অনেক অ্যাপ আছে, যারা কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝামেলামুক্ত লোন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তাদের সবাই এমন প্রতারক নয়। তবে অনেকেই, যখন আপনি তাদের অ্যাপ ডাউনলোড করবেন সঙ্গে সঙ্গে তারা আপনার কন্টাক্ট, ফটো এবং আইডি কার্ড পেয়ে যাবে। তারপর এসব ব্যবহার করে আপনাকে নানাভাবে হয়রানি করবে। যখন কোনো কাস্টমার সময়মতো ঋণের কিস্তি দিতে না পারেন, আবার যখন সময়মতো পরিশোধও করেন, তবু তারা আপনার সমস্ত তথ্য একটি কলসেন্টারে শেয়ার করবে। সেইসব কলসেন্টারে যুবক বা যুবতী এজেন্টের হাতে আছে ল্যাপটপ এবং ফোন। তারা হয়রানি করার জন্য প্রশিক্ষিত।
এমনই এক ফাঁদে ২০২১ সালে পা দিয়েছিলেন ভূমি সিনহা। তিনি বেশ কয়েকটি অ্যাপ থেকে প্রায় ৪৭,০০০ রুপি ঋণ করেন। এই অর্থ তিনি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে পেয়েছিলেন। তবে চার্জ হিসেবে এর বড় একটি অংশ কেটে রাখা হয়। সাতদিন পরে তার কিস্তি পরিশোধের কথা ছিল। তার খরচও মেটাতে পারেননি। ফলে তাকে আরেকটি অ্যাপস, পরে একইভাবে আরেকটি অ্যাপস থেকে ঋণ নিতে থাকেন। এভাবে লোন এবং সুদ মিলে তিনি প্রায় ২০ লাখ রুপির দেনা হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে অর্থ সংগ্রহকারী এজেন্টরা তাকে ফোন দেয়া শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের আচরণ খারাপ হয়ে পড়ে। তারা নানাভাবে ভূমিকে অপমান ও নির্যাতন করতে থাকে। এমনকি তিনি যখন কিস্তি পরিশোধ করেন, তখন বলা হয় মিথ্যা কথা বলছেন। দিনে ২০০ বার পর্যন্ত তারা কল করতে থাকে। তারা জানতো তিনি কোথায় বাস করেন। এক পর্যায়ে তারা তাকে একটি মৃতদেহের ছবি পাঠায়। এর মধ্যদিয়ে তাকে বার্তা দেয়। এই নির্যাতন যখন বাড়তেই থাকে, তখন তারা তাকে হুমকি দেয়। বলে, তার মোবাইলের কন্টাকে যে ৪৮৬ জনের ফোন নম্বর আছে তাদেরকে মেসেজ দেবে যে ভূমি একজন চোর এবং দেহপসারিণী। যখন তারা তার মেয়ে আস্থার সম্মান ক্ষুণ্ন করার হুমকি দেয়, তখন ভূমি আর ঘুমাতে পারেন না। এ অবস্থায় তিনি বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য এবং আরও অ্যাপসের (সব মিলে ৬৯টি) কাছ থেকে আরও লোন করেন। রাতভর তিনি প্রার্থনা করেন, আর যেন সকাল না হয়। সকাল সাতটার সময় হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। একটানা বাজতেই থাকে। ততদিনে তিনি সব অ্যাপসের লোন শোধ করেছেন। কিন্তু বিশেষ করে একটি অ্যাপ, যার নাম আসান লোন, তারা ফোন দেয়া বন্ধ করেনি। ফলে ভূমি কাজে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। ভেতরে ভেতরে বেদনায় কুঁকড়ে যেতে থাকেন।
এরই মধ্যে তার এক সহকর্মী ফোনে তার টেবিলে ডেকে পাঠান। সেখানে গেলে তিনি ভূমিকে তার ফোনে কিছু দেখান। তা ছিল একটি নগ্ন ছবি। ভূমির পর্নোগ্রাফিক ছবি। এই ছবিটি ফটোশপে বানানো। তবু তা দেখে ভূমির মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়। তিনি হতাশা আর লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলেন। ওই সহকর্মীর টেবিলেই অচেতন হয়ে পড়ে যান। ভূমির ফোনকলে যেসব নম্বর সেভ করা ছিল তার প্রতিটিতে এই ছবি পাঠায় আসান লোন। এর ফলেই ভূমি আত্মহত্যার চিন্তা করেন।
বিশ্বে বিভিন্ন দেশে এমন প্রতারণার তথ্যপ্রমাণ দেখা গেছে। কিন্তু শুধু লোন অ্যাপস ব্যবহারের ফলে এমন ঘটনায় ভারতে আত্মহত্যা করেছেন কমপক্ষে ৬০ জন। এর বেশির ভাগের বয়স ২০-এর কোটা থেকে ৩০-এর কোটায়। এর মধ্যে আছেন একজন অগ্নিনির্বাপণকারী, একজন পুরস্কারবিজয়ী সংগীতজ্ঞ, একজন যুবতী মা ও তার স্বামী। শেষোক্ত দম্পতি তাদের তিন ও পাঁচ বছর বয়সী দুটি কন্যা সহ আত্মীয়স্বজনকে রেখে গেছেন। তারা দু’জনেই এমন অ্যাপস ব্যবহার করে লোন নিয়েছিলেন।
বিবিসি একজন ঋণ সংগ্রহকারী যুবককে শনাক্ত করতে পেরেছে। সে অনেক লোন অ্যাপসের জন্য কলসেন্টারে এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো। তার নাম রোহান (ছদ্মনাম)। কীভাবে লোন গ্রহণকারীদের নির্যাতন করা হয় সে বিষয়ে তিনি বলেছেন। রোহান বলেন, অনেক কাস্টমার কান্নাকাটি করেন, কেউ আত্মহত্যা করার হুমকি দেন। তিনি বলেন, এসব বিষয় আমাকে সারারাত ভাবাতো। রোহান সব প্রকাশ করে দেন বিবিসি’র কাছে।
বলেন, ম্যাজেস্টি লিগ্যাল সার্ভিসেস এবং কলফ্লেক্স করপোরেশন নামের দুটি কলসেন্টারে চাকরির আবেদন করেন তিনি। ছদ্মবেশে তিনি ছবি তুলতে কয়েক সপ্তাহ কাটান। কীভাবে কাস্টমারকে তরুণ এজেন্ট হয়রান করেন তা তিনি ভিডিওতে ধারণ করেছেন। এমন এক ভিডিওতে এক নারী এজেন্ট বলেন, আমার কথা শোন না হলে আমি তোমাকে শেষ করে দেবো। এক পর্যায়ে ওই কাস্টমার ফাঁসি নেন। অন্যদিকে ওই এজেন্ট হাসতে থাকেন। অন্যজন বলতে থাকেন, ওই ক্লায়েন্টের উচিত হলো ঋণ পরিশোধ হিসেবে তার মাকে বিপথে নামানো। এমন হয়রানির কমপক্ষে ১০০ ভিডিও ধারণ করেছেন রোহান। সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন তিনি দেখেছেন দিল্লির ঠিক বাইরে কলফ্লেক্স করপোরেশনে। সেখানে এজেন্টরা নিয়মিত ক্লায়েন্টকে অপমান করে এবং হুমকি দেয়। এসব কিছুর তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা দেন কলসেন্টারের ম্যানেজাররা। তাদের একজন বিশাল চৌরাশিয়া। তার আস্থা অর্জন করেছিলেন রোহান। সে একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে একজন সাংবাদিককে সঙ্গে নেন এই দুর্নীতির ব্যাখ্যা পেতে। যখন কোনো কাস্টমার লোনের জন্য আসে, তখন তারা তাকে ঋণ দেয়ার জন্য তার কন্টাক্ট লিস্টে প্রবেশাধিকার চায়। এটা অ্যাপসের মধ্যেই সেট করা থাকে। অর্থ তুলে দেয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছে কলফ্লেক্স করপোরেশনকে। যদি কোনো কাস্টমার অর্থ দিতে দেরি করেন বা মিস করেন, তাহলে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এর ফলে লজ্জায় পড়ে কাস্টমার অর্থ জমা দেন।
এ অবস্থায় চৌরাশিয়া এবং কলফ্লেক্স করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু তারা কোনো কথা বলেননি। তাদের ফাঁদে পড়ে জীবন শেষ করেছেন এমন অনেকের একজন কিরনি মনিকা। তিনি ২৪ বছর বয়সী একজন সরকারি চাকরিজীবী এবং পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। তার পিতা একজন সফল কৃষক। তিনি চেয়েছিলেন মনিকাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠাবেন মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে। তিন বছর আগে এক সোমবার আত্মহত্যা করেছেন মনিকা। তিনি আশা করতেন স্কুটার চালিয়ে কাজে যাবেন। তার পিতা কিরনি ভূপানি বলেন, সে ছিল সব সময় হাস্যোজ্জ্বল। মনিকা লোন নিয়েছেন তা তার পিতা জানতেন না। আত্মহত্যার পর পুলিশ মনিকার ফোন এবং ব্যাংক স্টেটসমেন্ট পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তিনি ৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন লোন অ্যাপ থেকে অর্থ ঋণ নিয়েছেন। প্রথম শুরুটা হয়েছিল ১০ হাজার রুপি দিয়ে। আস্তে আস্তে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩০ গুণ। পরিশোধ করেছিলেন কমপক্ষে তিন লাখ রুপি। তারপর তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
পুলিশ বলেছে, ওইসব অ্যাপস থেকে ফোন কল দিয়ে এবং অশালীন মেসেজ পাঠিয়ে তাকে হয়রানি করা হচ্ছিল। এমনকি মনিকার সব কন্টাক্টসে তারা মেসেজ পাঠাতে শুরু করে। মনিকা এখন পরিবারের কাছে শুধুই স্মৃতি। তার কক্ষকে একটি অস্থায়ী সমাধি বানিয়েছে পরিবার। দরজায় ওর টাঙানো সরকারি আইডি কার্ড। তার বিয়ের জন্য মা যে ব্যাগ কিনেছিলেন তা ঝোলানো। তার পিতাকে সবচেয়ে ব্যথিত করেছে যে ঘটনা তা হলো মনিকা বিষয়টি তার সঙ্গে শেয়ার করেনি। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে যখন মনিকার মৃতদেহ আনতে গিয়েছি, তখনো তার ফোন বাজছিল। তিনি ফোন ধরতেই অশালীন কথাবার্তা বলা হয়। জবাবে তিনি অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন।
মনিকা যে অ্যাপস থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তার কলসেন্টারে কাজ করতেন হরি (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, যখন কোনো ক্লায়েন্ট আত্মহত্যার হুমকি দেয়, কেউই তা সিরিয়াসলি নেয় না। তারপরই আত্মহত্যা ঘটতে থাকে। তার বসের নাম পরশুরাম টাকভে বলে উল্লেখ করে সে। তিনি অফিসে গিয়ে তাদেরকে ধমক দেন। বলেন, তোমাদেরকে যা করতে বলা হয়েছে তাই করো। এজেন্টরা তাই করতেন। মনিকা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আরও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন টাকভে। এই অপারেশন তিনি একা চালান না। হরি বলেন, কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই সফটওয়্যার ইন্টারফেস পাল্টে যেতো চীনা ভাষায়। টাকভে বিয়ে করেছেন চীনা যুবতী লিয়াং টিয়ান টিয়ানকে। তারা দু’জনে মিলে ঋণ উদ্ধারকারী ব্যবসা- জিয়ালিয়াং চালু করেন পুনেতে। সেখানেই কাজ করতেন হরি। হয়রানির অভিযোগ তদন্তের জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাদের দু’জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস পরে জামিনে ছেড়ে দেয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি, ভীতিপ্রদর্শন এবং আত্মহত্যার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়ার অভিযোগ গঠন করা হয়। কিন্তু বছরের শেষ দিকে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
আরো পড়ুন : রাশিয়ার অনুমতি নিয়ে নিজস্ব কারখানায় অস্ত্র-গোলাবারুদ বানাচ্ছে হামাস