আহমেদ ইদ্রিস। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় বোমাবর্ষণ থেকে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে গত বছর নিজের শহর ছেড়ে বহু দূরে শান্ত শহর হিসেবে পরিচিত সারাকিবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বোমাবর্ষণের কোনো ভয় ছিল না। নির্ভয়ে জীবন কাটছিল ইদ্রিস এবং তার পরিবারের। ভাগ্যের কী পরিহাস, সারাকিবে এসেও পরিবারের কাউকে বাঁচাতে পারলেন না। নিজে বাঁচলেও ২৫ স্বজনকে হারিয়েছেন তিনি। দানব ভূমিকম্প কেড়ে নিয়েছে তাদের জীবন। কেবল সিরিয়ায় নয়, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকা তুরস্কেও বেসামাল পরিস্থিতি। এরই মধ্যে ভূমিকম্প কেড়ে নিলো হাজার হাজার মানুষ। জীবিতদের ঠেলে দিল আশ্রয়হীন আর ক্ষুধার জগতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বিতীয় মানবিক দুর্যোগের সতর্কতা জারি করেছে। আশ্রয়হীনদের স্বাস্থ্য সমস্যা বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ত্রাণ দিতে রাজনৈতিক কৌশল বিবেচনা করছে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
আরো পড়ুন : মৃত্যু সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়ালো তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে
গণকবরে বাড়ছে কফিনের সংখ্যা
তুরস্কে ও সিরিয়ায় গতকাল রাত পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহ উদ্ধার করা যেমন কঠিন তার চেয়েও বেশি কঠিন লাশ চিহ্নিত করা। আন্টাকিয়ার একটি হাসপাতালের পার্কিং লটে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার ব্যাগ রাখা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের বলে দেওয়া হয়েছে, পরিচিতের দেহ খুঁজে পেলে নিয়ে যেতে। রানিয়া জয়াবৌবি নামের এক তরুণী বলেন, চাচীকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু চাচাকে পাইনি। সিরিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আসা রানিয়া এ দেশে এসেও সব হারালেন। তার পরিবারের আট জন মারা গেছে ভূমিকম্পে। গাড়িতে করে কবরস্থানগুলোতে একের পর এক মৃতদেহ আসছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কন্টেইনারগুলোকে মোবাইল মর্গ করা হয়েছে। নতুন কফিন তৈরি করতে হয়েছে অনেক। কিছু কফিন তৈরি করা হয়েছে পাইন গাছ কেটে। কিছু দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে পুরানো আলমারিই হয়ে গেছে কফিন। গণকবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওসমানিয়েতে বৃহস্পতিবার একসঙ্গে ৪০০ কবর দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংখ্যা তো কিছুই নয়।
আরো পড়ুন : তুরস্কে পৌঁছেছে ৬০ জনের উদ্ধারকারী দল সি-১৩০ বিমান
ভয়াবহ মানবিক সংকট
যারা জীবিত আছেন তারা আরও বড় সংকটের মুখে। নেই থাকার জায়গা, নেই খাবার। গত পাঁচদিনেও অনেকে ত্রাণ পাননি। এমনকি অনেকে স্বজনদের খোঁজ চাইলেও উদ্ধারকর্মীর অভাবে সেটাও পাচ্ছেন না। ধ্বংসংস্তূপের কাছে বসেই দিন কাটছে। অনেক পরিবার তো রাস্তায় আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। ছোট ছোট সন্তান নিয়ে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যেই দিন-রাত পার করতে হচ্ছে। ইস্তাম্বুলের একজন তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু বলেছেন, লোকেরা এখনো ধসে পড়া ভবনের নিচে রয়েছে, তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে আটকে পড়া লোকজন তাকে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছে। হাসকোলোলু বলেন, তারা আমাদের বলছে যে তারা কোথায় আছে এবং আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তিনি বলেছেন, তুরস্কের জন্য এখন প্রয়োজন সমস্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা। বিধ্বস্ত শহরগুলোতে বহু মানুষ এখনো আশ্রয়হীন। তাদের কাছে নিরাপদ খাবার পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই।
আরো পড়ুন : মৃত্যুর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াল তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে
তুরস্কের চেয়ে মৃত্যু কম হলেও সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল। তিন দিন পরে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের ত্রাণসাহায্য পৌঁছায় দেশটিতে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, সিরিয়া ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে। কারণ গত কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে এমনিতেই দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাই দেশটির জন্য আরও সহায়তা দরকার।
আরো পড়ুন : ভূমিকম্পের পর প্রচণ্ড ঠান্ডা আর ক্ষুধা এখন তুরস্কের নতুন বিপদ
উত্তর সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজন সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করছেন, কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো প্রায় কেউ নেই। উত্তর সিরিয়ার একটি হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার মোহাম্মদ হাসাউন জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর এখন তাদের কাছে যে চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্স খবর দিচ্ছে, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি গতকাল শুক্রবার জানিয়েছে যে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায়, যেখানে ৯০ শতাংশ মানুষ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে খাদ্যের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
আরো পড়ুন : তুরস্কে ভূমিকম্পের ৫৫ ঘণ্টা পর উদ্ধার মায়ের দুধে বেঁচে থাকা ১৮ মাসের মাশাল
দ্বিতীয় মানবিক দুর্যোগের মুখে দুই দেশ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা করছে, এই পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আরও অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ডব্লিউএইচও অনুমান করছে, তুরস্ক এবং সিরিয়াজুড়ে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ এই ভূমিকম্পের শিকার হয়েছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তুরস্কে ১৯ হাজার ৩৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৯ সালে দেশটিতে ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। সিরিয়ায় মারা গেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তুরস্কের বাসিন্দা রেসাত গজলু জানিয়েছেন, তিন দিনের মধ্যে কোনো উদ্ধারকর্মী কিংবা ত্রাণ পাননি। তিনি জানান, উদ্ধারের অভাবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অনেকের শরীরে তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। ফলে জীবিত উদ্ধার হলেও তাদের পরবর্তীতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর বেঁচে থাকলেও তার জীবনে এটা স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে থেকে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে জানিয়েছে, জীবিতরা যদি আশ্রয়, খাবার ও চিকিৎসা ঠিকমতো না পান তাহলে দ্বিতীয় দুর্যোগের মুখে পড়বেন তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ বিষয়ক পরিচালক ড. হ্যানস ক্লুগ বলেছেন, তুরস্কের গাজিয়ানতেপে তাদের কর্মীরা তিন দিন ধরে গাড়িতে ঘুমাচ্ছেন। কারণ সেখানে শত শত আফটারশক হচ্ছে। তিনি জানান, সিরিয়ায় পানির অভাব হচ্ছে। সেখানে পানির যে কুয়ো আছে তাও ফুরিয়ে আসছে। এগুলো প্রতিস্থাপন করা দরকার।
আরো পড়ুন : ভয় কাটেনি, তবে আল্লাহর রহমত যে আমরা এখনো বেঁচে আছি
ত্রাণে রাজনীতির অভিযোগ
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করছে এমন একটি বেসামরিক ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেট-এর প্রধান জাতিসংঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের পদক্ষেপ ছিল খুবই বাজে। রায়েদ আল-সালেহ বলছেন, জাতিসংঘ নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের প্রথম ত্রাণবাহী গাড়িবহর তুরস্ক থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করে। তবে হোয়াইট হেলমেট বলছে, ঐ রসদপত্র ভূমিকম্পের আগে সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল এবং উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য জরুরি রসদপত্র তাতে ছিল না। ইডলিব থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে জেনেভায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার সময় আল-সালেহ বলেন, ভূমিকম্পের ১০০ ঘণ্টা পর যে ত্রাণ বহর উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় পৌঁছেছে তাতে ছিল মাত্র ছয় ট্রাক ভর্তি সাহায্য সামগ্রী। এগুলো ভূমিকম্পের আগেই সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা অবশ্যই আল-সালেহ’র এই ব্যাখ্যা মেনে নেবেন না। জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সংস্থার প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস এ সপ্তাহান্তে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় যাচ্ছেন। তবে এই সফরের সময় তিনি হোয়াইট হেলমেট কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। ভূমিকম্প আঘাত হানার পর চার দিন পার হয়েছে এবং সাহায্যের অভাবে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার পরিস্থিতি মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে বিবিসি সংবাদদাতারা জানিয়েছেন। -বিবিসি, আলজাজিরা ও সিএনএন
আরো পড়ুন : ঢাকায় সড়ক আইনে ২০২২ সালে আড়াই লাখের বেশি মামলা, জরিমানা ৫৫ কোটি টাকা