ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে এক কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য ‘ছল, বল ও কৌশলের’ আশ্রয় নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। তাঁর নাম আব্দুস সালাম ব্যাপারী। তিনি ঢাকা ওয়াসার বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। আব্দুস সালামকে নিয়োগের জন্য একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তির শর্ত। নিয়োগের যোগ্য করতে তাঁকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। তারপর কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার ছাড়াই তিনজনের তালিকায় আব্দুস সালামের নাম সবার ওপরে দিয়ে পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে।
যদিও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকে আবেদনও করেছিলেন। এদিকে মন্ত্রণালয় তিনজনের নামের তালিকাটি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠিয়েছে। সেখান থেকেই নিয়োগ হবে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদগুলোর নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আর্থিক লেনদেনের অনেক অভিযোগ ছিল।
ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে ২০০৯ সালে নিয়োগ পেয়ে ১৫ বছর তা আঁকড়ে থাকেন তাকসিম এ খান। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারি অর্থের অপচয়ের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকসিম এ খান আত্মগোপনে চলে যান। গত বছরের ১৪ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন।
ঢাকা ওয়াসায় এরপর আর স্থায়ী এমডি নিয়োগ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সাময়িকভাবে তিনজনকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান মিয়া। তাঁকেও গত ৩০ অক্টোবর সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে পদটি শূন্য।
অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের ব্যক্তিকে বসানোর জন্যই পদটিতে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে ‘পছন্দের ব্যক্তি’ আব্দুস সালামের বিরুদ্ধ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বিগত সরকারের আমলে তাঁকে প্রায় চার বছর প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে সংযুক্ত করে রাখা হয়, যা অনেকটা জনপ্রশাসনের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখার মতো। অর্থাৎ কোনো কাজ দেওয়া হয় না।
চার বছরের বেশি সময় ধরে সংযুক্ত করে রাখার বিষয়ে আব্দুস সালামের ভাষ্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকসিম এ খান তাঁকে সংযুক্ত করে রেখেছিলেন।
আব্দুস সালাম তাঁর কার্যালয়ে রোববার বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাজে তাঁর মতো অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বাংলাদেশে নেই। অন্য কাউকে এই পদে দায়িত্ব দিলে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। কারণ, তাঁদের পানি সরবরাহসংক্রান্ত প্রকৌশল কাজের ধারণা নেই।
রাজধানীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা ওয়াসায় এখন প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে উন্নয়নকাজ চলছে। তাই সেখানে এমডি পদে কে বসলেন, প্রকল্প পরিচালক কে হলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এসব পদে নিয়োগের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ আগাম লেনদেনের অভিযোগও থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার দুজন কর্মকর্তা বলেন, আব্দুস সালাম দুর্নীতির অভিযোগে সংযুক্ত ছিলেন। এখন কেন তাঁকে এমডি করা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। তাঁরা আরও বলেন, ঢাকা ওয়াসার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ কাউকে পূর্ণাঙ্গভাবে এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার নজির নেই। কী এমন যোগ্যতা আছে যে আব্দুস সালামকেই নিয়োগ দিতে হচ্ছে?
অবশ্য নথিপত্রে দেখা যায়, আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। বিভাগীয় মামলাও হয়েছিল। সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আব্দুস সালাম নিজেকে বঞ্চিত দাবি করতে শুরু করেন এবং প্রভাব বিস্তার করে বিভাগীয় মামলা প্রত্যাহার করান।
ছল, বল, কৌশল : ঢাকা ওয়াসায় এমডি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় গত ২১ মার্চ। তাতে বলা হয়, অভিজ্ঞ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়স ৬০ বছরের বেশি হলেও আবেদন করা যাবে এবং আবেদনকারীর ন্যূনতম তৃতীয় গ্রেডের (ধাপ) কর্মকর্তা হতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, আব্দুস সালাম তখন চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা ছিলেন, তাই ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী তিনি আবেদন করার যোগ্য ছিলেন না।
তিন দিনের মাথায়, অর্থাৎ ২৩ মার্চ হঠাৎ নতুন করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে আগের শর্ত বাদ দিয়ে বলা হয়, আবেদনকারীর বয়স ৬০ বছরের বেশি হলে আবেদন করা যাবে না।
ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, অভিজ্ঞদের জন্য বয়স শিথিলযোগ্য থাকলে অনেক যোগ্য প্রার্থী আবেদন করতেন। সেটি ঠেকাতেই নতুন শর্ত যোগ করা হয়।
নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এরপর স্থগিত থাকে কয়েক মাস। এ সময়ের মধ্যে আব্দুস সালামকে দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা হয় এবং প্রধান প্রকৌশলীর (চলতি দায়িত্ব) পদে বসানো হয়।
সর্বশেষ গত ১৫ জুলাই নতুন করে এমডি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা ওয়াসা। সেখানে আবেদনের শর্ত পূরণ করেন আব্দুস সালাম।
সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাপ্ত আবেদনকারীদের মধ্য থেকে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে যোগ্য ও বিবেচিত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য আহ্বান জানানো হবে।
ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি দেখে ৩৭ জন আবেদন করেন। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন পানিসম্পদ বিষয়ে পিএইচডিধারী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলীসহ অভিজ্ঞ অনেক প্রার্থী। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা কাউকে সাক্ষাৎকারে ডাকেনি।
সূত্র বলছে, সাক্ষাৎকারে না ডাকার পরিবর্তে ঢাকা ওয়াসার ‘কর্মসম্পাদন সহায়তা কমিটি’ সরাসরি তিনজন প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তালিকার প্রথমে রাখা হয় আব্দুস সালামের নাম। দ্বিতীয় স্থানে ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান এবং তৃতীয় স্থানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এনামুল হকের নাম রয়েছে।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহের মাঝামাঝিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এই তালিকাই হুবহু প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠিয়েছে।
বোর্ড নেই, সরকারের হাতে ক্ষমতা : ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদই এমডি পদে নিয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬-এর ৩১ ধারায় বলা আছে, ওয়াসার এমডি নিয়োগের একমাত্র এখতিয়ার ওয়াসা বোর্ডের।
অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ২৪ অক্টোবর একটি অধ্যাদেশ জারি করে আইনের ধারায় কিছু সংশোধনী আনা হয়। সেখানে বিশেষ পরিস্থিতিতে বোর্ড ভেঙে দেওয়া এবং নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে নেওয়া হয়।
এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঢাকা ওয়াসার নতুন বোর্ড গঠন করা হয়নি। নতুন অধ্যাদেশে থাকা ‘কর্মসম্পাদন সহায়তা কমিটি’র মাধ্যমে কাজ চলছে। ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে। আর সদস্যসচিব হিসেবে রাখা হয় ঢাকা ওয়াসার সচিবকে।
কমিটিতে আরও সাতজনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়। তাঁরা হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রতিনিধি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে মোহাম্মদ এজাজ (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্তমান প্রশাসক) ও ছাত্র প্রতিনিধি আহনাফ সাঈদ খান।
পছন্দের ব্যক্তিকে ঢাকা ওয়াসার এমডি নিয়োগ দিতে নানা কৌশলের বিষয়ে কথা বলতে কমিটির আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে।
কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সুরাইয়া আখতার জাহানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও জবাব পাওয়া যায়নি।
কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মীর আবদুস শহিদের সঙ্গেও একইভাবে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
রোববার দুপুরে কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা ওয়াসার সচিব মশিউর রহমান খানের কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।
সরকারকে এখনই এই প্রক্রিয়া বাতিল করে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নইলে জনসেবা নয়, ঢাকা ওয়াসা হবে ক্ষমতাবানদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বিআইপি
বাতিল ‘করতে হবে’ : এদিকে ঢাকা ওয়াসার এমডি নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছে। এমডি পদে তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ স্থগিত চেয়ে মো. লিয়াকত আলী নামের এক ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানির পর ৩ নভেম্বর আদালত বিজ্ঞপ্তিটি স্থগিত করে রুল জারি করেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার ঢাকা ওয়াসা শীর্ষস্থানীয় পদগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা করতে পারত, যেখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও শর্তের কথা উল্লেখ করা যেত। তার পরিবর্তে কৌশলে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়।
জানতে চাইলে নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নিয়োগপ্রক্রিয়া যদি ‘পছন্দের মানুষ বসানোর’ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়, তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠবে। এই প্রক্রিয়া একদিকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করছে, অন্যদিকে সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহিত করছে।
তিনি বলেন, সরকারকে এখনই এই প্রক্রিয়া বাতিল করে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নইলে জনসেবা নয়, ঢাকা ওয়াসা হবে ক্ষমতাবানদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
সুত্র- প্রথম আলো
