নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করা দলগুলোর দ্বিতীয় দফার যাচাই-বাছাই শেষ। এ দফায় ৬০টিরও বেশি দল টিকে গেছে। উত্তীর্ণ দলগুলোর তালিকা আগামী মাসেই ইসির কমিশন সভায় উপস্থাপন করা হবে। এরপর কমিশন নির্বাচিত দলগুলোর মাঠপর্যায়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত দেবে। ইসির একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই প্রথম দফা যাচাই-বাছাই শেষে প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ ৭৭টি দলের মধ্যে যেসব দলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতি ছিল, তা জমাদানের নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আলোচিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-বিডিপি, আমার বাংলা পার্টি-এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করেছে। বাকি ১৪-১৫টি দল নির্দিষ্ট সময়ে কাগজপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের বাদ দিয়ে অন্তত ৬০-৬২টি নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের তালিকা কমিশন সভায় পেশ করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা আগামী মাসেই পেশ করা হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক ও ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণদের মধ্যে যেসব দলের কাগজপত্রের কিছু ঘাটতি ছিল সেসব দলকে কাগজপত্র সরবরাহের চিঠি দেওয়া হয়। অনেকেই তা সরবরাহ করছে আবার অনেকেই করেনি। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে আমরা একটি তালিকা প্রস্তুত করছি। আগামী মাসের কমিশন সভায় সেটি উপস্থাপন করা হলে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’
দলগুলোর মাঠ জরিপ করা হবে কিনা–এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হবে। আর সিদ্ধান্ত শেষে প্রয়োজন হলে আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাই মাঠ জরিপ করবেন।’
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে এবার ৯৮টি দল আবেদন করে। এর মধ্যে ৫টি দল একাধিক আবেদন করায় সেগুলো বাদ দিয়ে আবেদনকারী দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩টিতে। সেখান থেকে আবার দুটি দল তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে। আর নানা অসংগতি ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা না দেওয়ায় প্রাথমিক বাছাইয়ে ১৪টি দলের আবেদন বাতিল করা হয়। বাকি ৭৭টি দলের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ইসি সচিবালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদন কমিশনে উপস্থাপন শেষে যেসব দলের সম্পূরক বা যেসব কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তা জমা দিতে ১৫ দিনের সময়সীমা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। গত ২৬ জানুয়ারি সেই সময়সীমাও শেষ হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জামায়াত সমর্থিত একেএম আনোয়ারুল ইসলাম চানের নেতৃত্বাধীন আলোচিত রাজনৈতিক দল বিডিপি এবং জামায়াত থেকে বেরিয়ে যাওয়া এএফএম সোলায়মান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দল এবি পার্টি, ঢাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দল তাদের কাগজপত্র জমা দেয়। কাগজপত্র জমা না দেওয়া অন্তত ১৪-১৫টি দলকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় যাচাই-বাছাই শেষে নির্বাচিত দলগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হলে এ দফায় টিকে যাওয়া দলগুলোর মাঠপর্যায়ে তদন্ত করা হতে পারে। এ পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের কার্যালয় ও কার্যক্রম আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবে নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে আগামী মাসেই মাঠ কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হতে পারে। আগামী জুনের মধ্যেই নতুন দলের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির রোডম্যাপে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, দলগুলোর নিবন্ধন পেতে হলে তিনটি শর্তের মধ্যে অন্তত একটি পূরণ করতে হবে। শর্ত তিনটি হলো–১. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত যে কোনো সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে দলীয় নির্বাচনী প্রতীকে একটি আসন পেতে হবে। ২. কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ৫ শতাংশ ভোট প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৩. দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় ও অন্তত ১০০টি উপজেলায় বা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় থাকতে হবে। আর প্রতিটি উপজেলায় দলের সদস্য হিসেবে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দুটি শর্ত পালন করা নতুন রাজনৈতিক দলের জন্য বেশ কঠিন। সেজন্য তৃতীয় শর্তকেই প্রাধান্য দেয় আবেদন করা দলগুলো। আবেদনের সঙ্গে তাদের জমা দেওয়া কাগজপত্র বা তথ্যের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের তথ্যে মিল রয়েছে কিনা, সেটি জানতেই মাঠ তদন্ত হবে। এরপর চতুর্থ ধাপ শুরু হবে। নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী, আবেদনে অন্তত ৯ ধরনের তথ্য পূরণ করতে হয় এবং সেইসঙ্গে ১০ ধরনের দলিলপত্রের সংযুক্তি দিতেই হবে।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক বাছাইয়ে ৭৭টি দল থাকলেও মাঠ যাচাইয়ে বেশিরভাগ দলই টিকবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, কাগজ-কলমে কার্যালয় থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব আছে কিনা, তা সন্দিহান। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে যে ২০০ জন স্বাক্ষর করেছেন তা সঠিক কিনা, সেটাও দেখার বিষয়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করা বিডিপির চেয়ারম্যান একেএম আনোয়ারুল ইসলাম চান ও সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক (নাঈম)। তারা দুজনেই জামায়াতের রুকন (শপথধারী সদস্য) এবং ঢাকা মহানগরীর মজলিশে শূরা সদস্য ছিলেন। তারা এখনো জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। অপরদিকে এবি পার্টির আহ্বায়ক সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন। সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মন্জু ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র আরও জানায়, বিডিপি তাদের নিবন্ধন আবেদনের সঙ্গে ২৫ হাজার ১৩৬ পৃষ্ঠা কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আর এবি পার্টি জমা দিয়েছে ৮ হাজার ৫৪ পৃষ্ঠা। তবে এ দুটি দলের আবেদনের বেশকিছু ঘাটতি ছিল। এবি পার্টির উপজেলা পর্যায়ের কমিটির যেসব তালিকা জমা দিয়েছে; সেখানে অনেক উপজেলায় ২০০ ভোটারের স্বাক্ষর নেই। একই অবস্থা গণঅধিকার পরিষদের। এ দলটি তাদের আবেদনের সঙ্গে ৪৭ হাজার ৯৭১ পৃষ্ঠা কাগজপত্র জমা দিয়েছে। ইসি থেকে সেই ঘাটতি ডকুমেন্টস চাওয়া হলে তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় দফায় সরবরাহ করে।
বিতর্কিত এসব দল দ্বিতীয় দফার বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা–জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘কাউকে রাখা বা বাদ দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই। এটা কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা শুধু যাচাই-বাছাই করে তালিকা উপস্থাপন করছি।’
আরো পড়ুন : সংগঠনের স্বার্থে ও দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে বিএনপি