নিজস্ব প্রতিবেদক : ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকা মহানগরে ২০২২ সালে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে। সংগঠনটি বলেছে, ২০২২ সাল সাধারণ মানুষের জন্য একদমই স্বস্তির ছিল না।
ক্যাব গতকাল শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, সবজি, ফলসহ প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। রান্নার জ্বালানি, সাবান, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসামগ্রী, স্যানিটারি ন্যাপকিন, মশার ওষুধ, পোশাকের দাম এবং পরিবহন ভাড়া ও শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেড় দশকে দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন), মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। তবু চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। নিম্নমধ্যবিত্তের প্রকৃত আয় খুব একটা বাড়েনি। অধিকাংশ আয়ই বেড়েছে উচ্চবিত্তের। ফলে দেশে দিন দিন আয়বৈষম্য বাড়ছে। তিনি বলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য কাল হয়ে আসে।
ক্যাব রাজধানীর ১১টি বাজার থেকে ১৪১টি খাদ্য ও ৪৯টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং ২৫টি সেবার তথ্য সংগ্রহ করে মূল্যবৃদ্ধির এ হিসাব করেছে। সংগঠনটি সাধারণত প্রতিবছর বার্ষিক প্রতিবেদনে জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি তুলে ধরে। ২০২১ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি তারা। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সংগঠনটি হিসাব করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। এবার মূল্যস্ফীতির হিসাবে দামের তুলনা করা হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসকে ভিত্তি ধরে। অর্থাৎ ওই মাসে যে দাম ছিল, সেটার সঙ্গে তুলনা করে মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির হিসাব করা হয়েছে। সার্বিকভাবে একটি গড় হিসাব তুলে ধরেছে তারা।
দেখা যায়, সার্বিকভাবে পণ্য ও সেবার গড় দাম বেড়েছে ১১ শতাংশের কিছু বেশি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এবার ক্যাব নিম্নআয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কেমন ছিল, তা আলাদাভাবে দেখিয়েছে। তারা বলছে, সাধারণ পরিবারের তুলনায় নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণের তুলনায় কিছুটা কম (৯ দশমিক ১৩) ছিল।
ক্যাবের পক্ষে বার্ষিক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মো. মাহফুজ কবীর। তিনি বলেন, শহরাঞ্চলের নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়েছে। এরা বেশি বিপাকে ছিল, কারণ সরকারের ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য বিক্রির সুফল তাদের বেশির ভাগই পায়নি।
মাহফুজ কবির আরও বলেন, দুধ, মাংস ও আটা এখন সচ্ছলদের খাবার হয়ে গেছে। নিম্নবিত্তের বেশির ভাগ মানুষ এগুলো এড়িয়ে চলছে। কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
দ্বিতীয় ভাগে মূল্যবৃদ্ধি বেশি
ক্যাবের প্রতিবেদনে একটি লেখচিত্র তুলে ধরা হয় যেখানে দেখা যায়, ঢাকায় ২০২২ সালের দ্বিতীয় ভাগে মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। এটা বেশি হারে বাড়তে শুরু করে মূলত মে মাস থেকে। সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা সামান্য কমে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ক্যাব জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও পরিবহন ভাড়াকে উল্লেখ করেছে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে দুটি দিক দেখা যায়—১. বছরের দ্বিতীয় ভাগে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের স্থায়ী মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। মানে হলো, এগুলোর দাম সহজে কমবে না। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকে এসব খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা (নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, পরিবহন ভাড়া, বাসাভাড়া ইত্যাদি)। ২. নিম্নআয়ের মানুষের সংসার ব্যয়ের বড় অংশজুড়ে থাকে খাদ্যপণ্য। এগুলোর দাম নির্ভর করে সরবরাহ ও মৌসুমের ওপর। এ ক্ষেত্রে দাম বছরের শেষ দিকে কিছুটা কমেছে।
ক্যাব আরও বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রায়দরিদ্র পরিবারের একটি অংশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে যায়। আবার কিছু দরিদ্র পরিবারকে হতদরিদ্রে পরিণত করে।
সারা দেশের পণ্য ও সেবার দাম বিশ্লেষণ করে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাদের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের আশপাশে অথবা নিচে ছিল। তবে গত আগস্টে তা সাড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই মাসেই দেশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড হারে বাড়ানো হয়। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে আছে।
বিবিএসের হিসাবে মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা, তার সঙ্গে মিল আছে ক্যাবের হিসাবের। যদিও ক্যাব শুধু ঢাকার বাজারের হিসাব দিয়েছে।
‘সামলাতে তো পারছি না’
রাজধানীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে নিত্যপণ্যের দামে নিয়মিত ওঠানামা হচ্ছে। তবে দাম কমে আগের পর্যায়ে যাচ্ছে না। যেমন গত বছর ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের ডজন ১৫৫ টাকায় উঠেছিল। এখন কমে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ডিম সাধারণত প্রতি ডজন ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে থাকে।
চাল, ডাল, তেল, চিনি, গরুর মাংস, মুরগি, সবজি ইত্যাদির মূল্যস্তরই বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের ট্রাকভাড়া, নিজেদের জীবনযাত্রার ব্যয় ও অন্যান্য খরচ বেড়েছে। বাড়তি কৃষকের উৎপাদন খরচও। ফলে ২০২১ সালে যে দাম ছিল, তাতে আর নামবে না।
বিপরীতে মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। বিবিএসের হিসাবে, ২০২২ সালের ১২ মাসে মজুরি বাড়ার হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ছিল। মানে হলো, মানুষের আয়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ইকবাল হোসেন বলেন, তিনি নির্দিষ্ট ও অতিরিক্ত সময়ের কাজের (ওভারটাইম) বেতনবাবদ মাসে ৩০ হাজার টাকার মতো আয় করেন। এক বছরে তাঁর বেতন মোটেও বাড়েনি। কারণ, তাঁর প্রতিষ্ঠানের বেচাবিক্রি পরিস্থিতি ভালো নয়। তিনি বলেন, ‘খরচ কমাতে গত সেপ্টেম্বরে কম ভাড়ার বাসায় উঠেছি। বাইরে খাওয়া-ঘোরা বন্ধ। ঘরের বাজার খরচের পরিমাণও নানাভাবে কমিয়েছি। এরপরও সামলাতে পারছি না।’
ইকবাল আরও বলেন, ‘চিকিৎসা ও বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ চালাতে এ মাসে চার হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে। আগে ২০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছিল। সেটাও শোধ করতে পারিনি।’
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সুপারিশ
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারও পদক্ষেপ নিয়েছে। নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে।
অবশ্য সরকার মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে, এমন পদক্ষেপই বেশি নিচ্ছে। এ বছরের শুরুতেই খুচরায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এর আগে গত ডিসেম্বরে বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। গ্যাসের দাম গত জুনে ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর ১৮ জানুয়ারি বাড়ানো হয় ৮২ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অদূর ভবিষ্যতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত হবে না। কেননা শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে।