সরকার আর নির্বাচন কমিশন যতই চেষ্টা করুক না কেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এক সাক্ষাতকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে মত দেবে। তখন তারা নির্বাচন বন্ধ করে জরুরি অবস্থা জারির কথা বলবে। এ রাষ্ট্রবিশ্লেষক আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কখনো সংবিধানের বাইরে যাবে না। কিন্তু সংবিধানের মধ্য থেকে কী করা যায়- তার নিয়ন্ত্রণ ইতিমধ্যে অনেকটা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই নির্বাচন থেকে জরুরি অবস্থার দিকেই এগুচ্ছে দেশ। তিনি বলেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায় আর জরুরি অবস্থা জারি হয়, তাহলে দেশ কার্যত গণতন্ত্র পরিপন্থি হয়ে যাবে। তখন জরুরি অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সংবিধান নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন হবে না। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, আমরা একটা জাতীয় বিপর্যয়ের মধ্যে আছি।
এখানে নরমাল ইলেকশন হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সীমাহীন দলীয়করণ হয়ে গেছে। এই দলীয়করণের মধ্যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে না। তবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময় পেলে তখন কিছু সুষ্ঠুতার মধ্যে যেতে পারে, পুরোটা না। প্রশাসন, পুলিশ, সবাই যখন একটি দলের পক্ষে চলে গেছে তখন নির্বাচন বিলম্ব হলে হয়তো তাদের সমর্থন কমবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চায় তাতে দেশ একটা গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যাবে। সে রকম গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে গেলে সংবিধানের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন হবে না। এ সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়ার কোনো কারণ নেই। এ শিক্ষাবিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। অবশ্যই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাকে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু শক্তি তো লাগবে। শক্তি হচ্ছে জনগণ। সেই জনগণকে এভাবে বিভক্ত করে রেখে শেখ হাসিনার নীতি সাফল্যের দিকে যাবে না।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে যেভাবে বিএনপিকে মামলা-মোকদ্দমা ও দমন-পীড়ন করে নিয়ন্ত্রণ করছে এ রকম নিয়ন্ত্রণ সব সময় করা যাবে না। শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় গেলে তখন এমন কিছু আর করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হয়ে গেলে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল সংঘবদ্ধভাবে সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করবে। আবার পুনরায় ক্ষমতায় আসলে শেখ হাসিনা বর্তমানে যে মর্যাদার আসনে আছেন সেই মর্যাদার আসনে আর থাকতে পারবেন না। তাকে অমর্যাদাকর অবস্থায় নিয়ে যাবে বিএনপি ও অন্যান্য দল। তখন রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুরাও শেখ হাসিনাকে অন্ধভাবে সমর্থন দেবে না। সংলাপের প্রশ্নে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে ‘ঔদ্ধত্য’ আচরণ করছেন তাতে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে সংলাপ করালে সেটি ভিন্ন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এমন চাইবে বলে মনে হয় না। তারা জরুরি অবস্থার দিকে যাবে এবং সেটি সংবিধান অনুযায়ী। তার মতে বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে কথা বলেন তা গণতন্ত্রবিরোধী। দলটির অন্যদের রেসপেক্ট করা উচিত। কেবল নিজেদের সবকিছু মনে করা এবং অন্যদের অসম্মান করা গণতন্ত্রবিরুদ্ধ কাজ। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, আওয়ামী লীগের হাত ধরেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাস, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধিদের চিঠি দিয়ে বলেছেন- সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় এই সরকার অবৈধ। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ- এই সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে গণ্য করবেন না। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে অনুরোধ করছি যেন এই সরকারকে দমন করা হয় এবং কোনো রকমের আর্থিক সহায়তা না দেয়া হয়। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহায়তাও দেবেন না। পত্রিকায় শেখ হাসিনার এই চিঠির কথা প্রকাশের পর অনেকে এটার বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি আমি নিজেও লিখেছি যে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের কাছে যাওয়া দরকার। জনগণকে সংগঠিত ও উন্নত চিন্তা-চেতনা দেয়া যেন তাদের তারা সমর্থন দেয়। সেটা না করে বিদেশি শক্তিগুলোকে চিঠি দেয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে অনুরোধ করবো তারা যেন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এ রকম কাজ আর না করে।
তিনি বলেন, যতদিন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল ততদিন তারা এই কাজ করেছে। তারা ক্রমাগত দূতাবাসগুলোকে বলেছে- বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন। এভাবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি কাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুরু করেছে। তখন আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে তা ভুল ছিল। যেটি জাতি রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। তার ধারাবাহিকতায় দেশ এখনো পর্যন্ত গণতন্ত্রের ওপর দাঁড়ায়নি। আজকে এটার জন্য এককভাবে বিএনপিকে দায়ী করা যাবে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি তিনটা দলকেই দায়ী করা যায়।
এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, যে দলটির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন, সেই দলের কাছ থেকে আমাদের আশাও বেশি ছিল, হতাশও বেশি হতে হয়েছে। এ কথা এজন্য বলছি যে এখনো সতর্ক হওয়া দরকার। আজকে যে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়ন কথা বলছে, লোক পাঠাচ্ছে এটা হচ্ছে বাংলাদেশ যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি তার প্রমাণ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আজ শেখ হাসিনা যেভাবে কথা বলছেন আমি মনে করি এটা ভালো। কিন্তু এর জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার। সেটিকে ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষ শক্তি বলে দেশকে যেভাবে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে সেক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা কঠিন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে বলে তারাই ক্ষমতায় থাকবে, জনগণ তাদের নির্দেশে চলবে। বাকিরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী- এই বিভাজনটা সম্পূর্ণ অনুচিত। কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মনের নাগরিকের এ রকম প্রতিহিংসা জাগিয়ে রাখা ঠিক না। প্রতিহিংসা তৈরি হতে পারে, কিন্তু ছয় মাস, এক বছর, দুই-তিন বছর পর তো মানুষ সেটা ভুলে গিয়ে কাজ কর্ম করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো অন্য কাজ করছে। এ রাষ্ট্রকে আমাদের সকলের রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, এ জাতিকে কীভাবে আমরা উন্নত জাতিতে পরিণত করতে পারি সেভাবে কাজ করা উচিত। এগুলো আওয়ামী লীগও হারিয়ে ফেলেছে, বিএনপিও হারিয়ে ফেলেছে।
আরো পড়ুন : ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোর বেশির ভাগই ঢাকার উত্তর সিটিতে