নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আন্তর্জাতিক জনপ্রতিনিধি তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি প্রচ্ছদ রাজনীতি শিল্প প্রতিষ্ঠান হ্যালোআড্ডা

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার পর এবার সেই তালিকায় একে একে যুক্ত হচ্ছেন পুতিন–ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দেশটির ধনকুবেররাও। আর এসব ধনকুবেরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা মিত্রদেশগুলো। নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে অলিগার্চ হিসেবে পরিচিত এসব ধনকুবেরের ব্যাংকিং লেনদেন সুবিধা এরই মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শেয়ারসহ সংশ্লিষ্ট দেশে থাকা ধনকুবেরদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও জব্দ করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন বহু বছর ধরেই তাঁর মিত্রদের এ রকম পরিস্থিতির বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। পুতিন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু পুতিনের খুব কাছের কেউ কেউ এই পরামর্শ গ্রহণ করলেও অনেকেই তাদের অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করে। এ ছাড়া তাদের অধিকাংশ কোম্পানি বিদেশি স্টক এক্সচেঞ্জেও তালিকাভুক্ত রয়েছে। এই অভিজাত ব্যবসায়ীরা এখন ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পরে নিজেদের সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন।

নিষেধাজ্ঞার কারণে দুশ্চিন্তায় থাকা পুতিন–ঘনিষ্ঠ সাত ধনকুবেরের মধ্যে পাঁচজনের মোট সম্পদের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। বাকি দুজনের সম্পদের পরিমাণ জানা যায়নি।

এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কতজন ধনকুবের ব্যক্তি এসব নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছেন, তার একটি বিবরণ দিয়েছেন বিবিসির অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিক ডেনিয়েল স্যান্ডফোর্ড। এখানে তেমনই কয়েকজনের তথ্য তুলে ধরা হলো:

আলিশার উসমানভ-নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

প্রেসিডেন্ট পুতিনের পছন্দের অলিগার্চদের অন্যতম আলিশার উসমানভ। ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১ হাজার ৭৬০ কোটি (১৭.৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের সম্পদ নিয়ে উসমানভ রাশিয়ার ধনকুবেরদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন। উজবেকিস্তানে জন্ম নেওয়া উসমানভ ইউএসএম হোল্ডিংসের মালিক। এই কোম্পানির অধীনে রয়েছে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল নেটওয়ার্ক মেগাফনসহ খনি ও টেলিকম খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও সেই দলে যোগ দেয়। এ নিষেধাজ্ঞাকে অন্যায্য দাবি করে উসমানভ বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা।

লেগ দেরিপাকসা-নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

রাশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ধনী ওলেগ দেরিপাকসা ১৯৯০–এর দশকে অ্যালুমিনিয়ামশিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজের সম্পদ বাড়াতে থাকেন। প্রতিষ্ঠা করেন এন প্লাস নামে একটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও ধাতু কোম্পানি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েন এই ধনকুবের। সংকট মোকাবিলায় লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত তাঁর কোম্পানির ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেন। এতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন থেকে কমে ৩ বিলিয়ন ডলারে (এক বিলিয়নে ১০০ কোটি) নেমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, দেরিপাকসা অর্থ পাচার, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। একজন ব্যবসায়ীকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। পূর্বের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে চলমান ইউক্রেন সংকটও তাঁর জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নিজের অবশিষ্ট সম্পদ রক্ষায় সম্প্রতি যুদ্ধ থামাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

গর সেচিন-নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত উপদেষ্টাদের একজন ইগর সেচিন। অধিকাংশ সময় তিনি থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। সেচিনকে পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও একজন বলে মনে করেন অনেকে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা—তিন ক্ষেত্রেই সেচিনের পদচারণ ছিল। পুতিনের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সেচিন বর্তমানে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রোসনেফটের পরিচালক। ধারণা করা হয়, তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির হয়েও কাজ করেছেন।

সেচিনের বিরুদ্ধে ২৮ ফেব্রুয়ারি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ ফ্রান্সের বন্দরনগরী মারসেইয়ের কাছ থেকে তাঁর একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরি জব্দ করে ফ্রান্স। নগদ টাকার সংকটে পড়ে জরুরিভাবে ফ্রান্স ত্যাগের সময় সেটিকে আটক করে ফরাসি কাস্টমস কর্মকর্তারা।

আর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ অজানা। ফলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাঁর সম্পদ খুঁজে বের করে তা জব্দ করা বেশ কঠিন কাজ হবে পশ্চিমাদের জন্য। তবে এসব নিষেধাজ্ঞাকে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধ বলে দাবি করেছেন সেচিন।

অ্যালেক্সি মিলার-নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

অ্যালেক্সি মিলার
রাশিয়ার ধনকুবের অ্যালেক্সি মিলার নব্বইয়ের দশকে সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র কার্যালয়ে বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটিতে পুতিনের সহকারী ছিলেন। পরে ২০০১ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি গ্যাজপ্রমের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে সময়ই মিলার দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক টাকা বানিয়েছেন বলে সন্দেহ করেন অনেকে।

তবে তাঁর মোট সম্পদ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ২০১৪ সালে তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। চলমান ইউক্রেন সংকটের সময়ও যা বহাল রাখা হয়েছে। যদিও মিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অভিযোগ আসায় তিনি গর্বিত। তার মানে সব কাজ ঠিকঠাক করছেন তিনি।

পিটর অ্যাভেন ও মিখাইল ফ্রিডম্যান-নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পুতিন–ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররাও

ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চেলসি এফসির মালিক রোমান আব্রামোভিচকে রাশিয়ার অভিজাত ধনকুবেরদের একজন মনে করা হয়। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার পুতিন–ঘনিষ্ঠ অনেক অভিজাত ধনকুবেরকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনলেও রোমান আব্রামোভিচকে এখনো কালো তালিকায় নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইইউ।

রাশিয়ার ক্রেমলিনে (পুতিনের দপ্তর ও বাসভবন) তিনি কতটা প্রভাবশালী তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি পুতিনের সঙ্গে কেবল সখ্য বজায় রেখে চলেন। অন্যরা মনে করেন পুতিনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ আর্থিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তাঁর প্রায় ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে এখন তিনি চেলসিকে তিন বিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করতে চাইছেন।

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *