পঞ্চগড় প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাতের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষে আরিফুর রহমান (২৮) ও জাহিদ হাসান (২৩) নামের দুই তরুণ নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে পুলিশের ৯ সদস্য ও ২ সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বেলা দুইটার দিকে পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে রাত পৌনে আটটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।
শুক্রবার পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা এ ঘটনায় দুজন নিহত হওয়ার কথা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
নিহত আরিফুর রহমান পঞ্চগড় পৌরসভার মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তাঁর স্বজনেরা জানিয়েছেন, আরিফুর শহরের একটি ছাপাখানার ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জুমার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় তিনি সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। স্থানীয় লোকজন আরিফুরকে উদ্ধার করে প্রথমে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
অপর দিকে নিহত জাহিদ হাসান নাটোরের বনপাড়া এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তাঁকে করতোয়া নদীর ধারে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আহমদিয়া জামাতের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশের চৌধুরী।
এ ঘটনায় ৯ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পঞ্চগড় সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাইয়ুম আলী, ভবেশ চন্দ্র পাল, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) কাজী কামরুল ইসলাম, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. আবদুল্লাহ, কনস্টেবল আল আমিন, ফরিদুর রহমান ও কামরুজ্জামান। সংঘর্ষের সময় তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছিল না। পরে পুলিশ লাইনস হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল এসে সদর থানায় তাঁদের চিকিৎসা দেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে দুজন সাংবাদিকও আহত হন। তাঁরা হলেন এসএ টেলিভিশনের পঞ্চগড় প্রতিনিধি কামরুজ্জামান ও অনলাইন সংবাদকর্মী ফাহিম হাসান।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
দুপুরে জুমার নামাজের মাধ্যমে জেলা শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের সালানা জলসার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এই জলসা আগামীকাল রোববার পর্যন্ত চলার কথা ছিল।
এই জলসা বন্ধের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। এই দাবিতে ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তেঁতুলিয়া-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। এ ছাড়া ওই দিন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের দুটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
আহমদিয়া জামাতের জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর চৌরঙ্গী মোড়ের আশপাশের বিভিন্ন গলি থেকে বিক্ষোভকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। বেলা সোয়া দুইটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পিছিয়ে সদর থানার ভেতরে আশ্রয় নেন। এ সময় থানা লক্ষ্য করে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়েন। পরে পুলিশ-বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকেন। তখন বিক্ষোভকারীদের একটি দল ধাক্কামারা এলাকা থেকে এসে করতোয়া সেতুতে অবস্থান নেন। তাঁরা সেখানে বাঁশ দিয়ে অবরোধ তৈরি করেন এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় করতোয়া সেতুসংলগ্ন ট্রাফিক পুলিশের একটি কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন পথে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বসতি আহম্মদনগরের দিকে যান। সেখানে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত ২৫টি বাড়িঘরে আগুন দেন। এ ছাড়া তাঁরা শহরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের চারটি দোকানের মালামাল বের করে অগ্নিসংযোগ করেন।
আহমদিয়া জামাতের সালানা জলসার মিডিয়া সেলে কর্মরত মাহমুদ আহমদ বলেন, তাঁদের ২০ থেকে ২৫টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। হামলায় অনেকেই আহত হয়েছেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার যাঁরা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন, তাঁরা শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনার দায় স্বীকার করেননি। এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পঞ্চগড় জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, শুক্রবারের মিছিলের বিষয়ে তাঁদের কোনো নির্দেশনা ছিল না। কারা মিছিল বের করেছেন, তা তাঁদের জানা নেই।
আটকা পড়েন সাধারণ মানুষ
জুমার নামাজের পর থেকে সংঘর্ষ শুরু হলে অনেকেই আর শহর থেকে বের হতে পারেননি। এ ছাড়া দুপুরের পর থেকে গণপরিবহনও বন্ধ ছিল। তবে সংঘর্ষের তীব্রতা বিকেল চারটার দিকে কমে আসে। এরপর অনেকেই করতোয়া সেতু হেঁটে পার হয়ে শহর ছাড়েন। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে শহরের ধাক্কামারা এলাকায় ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক বন্ধ করে দেন বিক্ষোভকারীরা। সাড়ে সাতটা পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। পরে পুলিশ-বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। রাত পৌনে আটটা থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
জলসা বন্ধের ঘোষণা
রাত পৌনে আটটার দিকে আহমদিয়া জামাতের সেই জলসাস্থলে যান জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা। তাঁরা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জসলা বন্ধের অনুরোধ করেন। পরে জলসা বন্ধ হয়।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশের চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসনের অনুরোধে জলসা বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের বিচার দাবি করছি।’
পুলিশ ও প্রশাসনের উদ্যোগে জলসা বন্ধ করা হয়েছে, তা জানাতে রাত নয়টার দিকে মাইকিং করা হয়। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ফিরতেও অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে হামলার ঘটনায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। রাত ১০টার দিকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা রাতে বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ দপ্তরের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : দারুস সালামে তিন শিক্ষার্থীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করল দুর্বৃত্তরা