ফরিদপুর গণসমাবেশের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীদের মুখে একটাই কথা, আওয়ামী লীগের ঘাঁটিখ্যাত এই জেলায় শক্তির পরীক্ষা দিতে চান তারা। এখানে লক্ষাধিক নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটাতে মরিয়া দলটির শীর্ষ নেতারা। আজ ফরিদপুরে সেই শক্তি প্রদর্শনের দিন ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির।
বিগত সমাবেশগুলোর মতো ফরিদপুরেও এক দিন আগেই শুরু হয়েছে পরিবহন ধর্মঘট। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে জেলায় সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরাও। তার ওপর পথে পথে ছিল পুলিশি তল্লাশি। বিভিন্ন মোড়ে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে প্রতিটি যানবাহন থামান দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা।
গতকাল সকালে দেখা যায়, ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সংযোগ মোড়ে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। বিএনপির গণসমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-বরিশাল সড়কে ফরিদপুর শহরের মুন্সিবাজার এবং ফরিদপুর-চরভদ্রাসন সড়কের গজারিয়াতেও পুলিশ তল্লাশি চালায়।
এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক তুহিন লস্কর বলেন, ফরিদপুরে পাঁচ দিনব্যাপী সড়কে বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশির জন্য একটি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে গাড়িগুলো তল্লাশি করা হচ্ছে।
গতকাল সকালে ফরিদপুর থেকে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলেনি। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফরিদপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, নতুন বাসস্ট্যান্ড ও শহরের ইমামুদ্দিন স্কয়ার এলাকাঘুরে যাত্রীদের যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। নতুন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, বাসগুলো টার্মিনালে সারিবদ্ধ করে রাখা। পরিবহন শ্রমিকরা কেউ কেউ কেরম ও লুডু খেলছেন।
রাজশাহীতে গতকাল জেলা ও মহানগর বিএনপির এক যৌথসভায় দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, সরকার নানা ষড়যন্ত্র করেও আমাদের বিভাগীয় গণসমাবেশ রুখতে পারেনি। তার প্রমাণ বিএনপি খুলনা, রংপুর ও বরিশালে দিয়েছে। শনিবার ফরিদপুরেও দেবে।
এদিকে আজ শনিবার সমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও বুধবার সন্ধ্যা থেকেই সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা। মাঠের মধ্যে তাঁবু টাঙিয়ে চলে আড্ডা ও স্লোগান। মধ্যরাতে ওই তাঁবুর নিচেই ঘুমিয়ে রাতযাপন করেন হাজারো নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা থাকছেন। মাঠেই চলছে রান্না।
সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়কারী ও বিএনপির ফরিদপুর (সাংগঠনিক) বিভাগীয় সম্পাদক শামা ওবায়েদ গতকাল বিকেলে কালবেলাকে বলেন, ‘মাঠ এখনই কানায় কানায় পূর্ণ। ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগের সব জেলা থেকে নেতাকর্মীরা এসেছেন। পদ্মার ওপার মানিকগঞ্জ থেকেও নেতাকর্মীরা এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে মাঠে প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী রয়েছেন। মাঠ ছোট, জায়গা হচ্ছে না। তিলধারণের ঠাঁই নেই। রাতে মাঠে আনন্দ আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় শিল্পীরা গান গাইবেন। সারা রাত ঘুম হবে না কারও। রান্না, খাওয়া ও বিশ্রাম সব এখানেই।’
তিনি বলেন, ‘সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের নির্দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডাকে পরিবহন মালিক ঐক্য পরিষদ। নেতাদের বাড়িতে হামলা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আমাদের সমাবেশ অলরেডি সফল। আজ শনিবার সমাবেশের মাধ্যমে আমরা আন্দোলনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাব।’
কোন জেলা থেকে আসছেন কত নেতাকর্মী
ফরিদপুর জেলা থেকে প্রায় এক লাখ নেতাকর্মী গণসমাবেশে যোগ দেবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা। তিনি কালবেলাকে বলেন, সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে জেলা বিএনপির অনেক নেতার বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে। গত চার দিনের মধ্যে জেলা থেকে ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে সব বাধা পেরিয়ে অভূতপূর্ব সমাবেশ হবে।
ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এএফএম কাইয়ুম জঙ্গী জানান, মহানগর থেকে ২৭ হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেবেন।
রাজবাড়ী থেকে ৬০ হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে রাজবাড়ীতে নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, হুমকি-ধমকি দিয়েছে। এ ছাড়া সমাবেশে আসার পথে রাস্তায় মোটরসাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
লিয়াকত আলী জানান, কাছাকাছি দূরত্বের লোকজন হেঁটে সমাবেশে যাবেন, অনেকে ট্রেনে করে যাচ্ছেন, মোটরসাইকেলে যাচ্ছেন।
মাদারীপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাহানদার আলী বলেন, তার জেলা থেকে ৭ হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেবেন। এর মধ্যে ৫ হাজার নেতাকর্মী ফরিদপুর পৌঁছেছেন।
শরীয়তপুর থেকে ১৫ হাজার নেতাকর্মী গণসমাবেশে যোগ দেবেন জানিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান কিরণ বলেন, ইতোমধ্যে টার্গেটের অর্ধেক নেতাকর্মী সমাবেশস্থলে চলে এসেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ভয়-ভীতি দেখাতে জেলার নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে এবং ২ জনকে আটক করেছে। কিরণ বলেন, গণসমাবেশকে ঘিরে তাদের উৎসবমুখর প্রস্তুতি ছিল; কিন্তু পুলিশ সেটা নষ্ট করে দিয়েছে। তিনি বলেন, নদীপথ ও ছোট ছোট গলি ব্যবহার করে বিকল্প উপায়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশে যাচ্ছেন।
গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকুজ্জামান জানান, তার জেলা থেকে পাঁচ হাজারের অধিক নেতাকর্মী সমাবেশে অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেন, এদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে চলে এসেছেন। তবে তারা একত্রে আসতে পারছেন না, পৃথকভাবে যে যার মতো করে আসছেন।
ফরিদপুরের গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর কালবেলাকে বলেন, আমাদের আগের সমাবেশগুলোর চেয়ে ফরিদপুরের সমাবেশে আরও বেশি লোকসমাগম হবে। আওয়ামী লীগ যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন, আমাদের থামিয়ে রাখতে পারবে না।
ফরিদপুরের গণসমাবেশ প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এএফএম কাইয়ুম জঙ্গী বলেন, বিএনপি যে এই এলাকায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল নয়, ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ফরিদপুরের সমাবেশে জনস্রোতে তা প্রমাণিত হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। সব বাধা পেরিয়ে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে দলটির গণসমাবেশ সফল হয়েছে বলে আলোচনা রাজনৈতিক মহলে।
আরো পড়ুন : জাতীয়তাবাদী যুবদল নেতা ইউসুফ বিন জলিলকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ