প্রার্থী চূড়ান্ত হবে শনিবার
গাজীপুরে ১৭, সর্বনিম্ন রাজশাহীতে
বিএনপি নেতাদের আগ্রহ নেই ভোটে থাকছে জাপা ও ইসলামী আন্দোলন
দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি। ৪১ নেতা দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম প্রার্থী রাজশাহীতে আর সর্বোচ্চ গাজীপুরে। ফলে বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে সরকারি দলের টিকিট পেতে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে তুমুল লড়াই হবে। এর মধ্যে একটি বাদে সবকটিতেই মেয়র আওয়ামী লীগের নেতারা। দলের অন্য নেতারাই তাঁদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
গতকাল বুধবার ছিল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। নির্বাচনে বিএনপি না থাকলেও জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন অংশ নেবে। তবে সরকারি দল কীভাবে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে দলের অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঐক্যবদ্ধ রাখবে– সেটাই বড় প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে দেখা যায়, গাজীপুরে ১৭, রাজশাহীতে ৩, সিলেটে ১০, খুলনায় ৪ ও বরিশালে ৭ জন নৌকার টিকিটপ্রত্যাশী। নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য এখনও বেশ সময় বাকি আছে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত হবে ১৫ এপ্রিল শনিবার। এ জন্য ওই দিন সকাল ১১টায় গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা ডাকা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা যোগ দেবেন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে, ১২ জুন বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনে এবং ২১ জুন সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনে গাজীপুর আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আওয়ামী লীগ। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বহিষ্কৃত মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান, সাবেক সহসভাপতি আসাদুর রহমান মিরন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান প্রমুখ।
এখানে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে শোনা যাচ্ছে নানা মত। কেউ বলছেন, সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাধারণ ক্ষমা করে আওয়ামী লীগ দলে ভিড়িয়েছে। সুতরাং তিনি এবারও পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন। আবার কেউ বলছেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রবীণ নেতা আজমত উল্লা খানকে দল মনোনয়ন দেবে। এ দুই প্রার্থীর সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে চমক থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। নতুন প্রার্থীর ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেলের নামই বারবার আসছে। সিটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে। মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও কাউন্সিলর মামুন মণ্ডলের কথাও বলছেন তাঁদের কর্মী-সমর্থকরা।
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর নির্ভর করছে নৌকা প্রার্থীর জয়-পরাজয়। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় কোনো নেতা নৌকা না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নৌকার পরাজয়ের আশঙ্কাও করছেন তাঁরা। সিলেটে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ব্যবসায়ী ও বাফুফে নির্বাহী সদস্য মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেও আগে কোনোভাবে জানান দেননি। আওয়ামী লীগের তালিকা দীর্ঘ হলেও প্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকটা নির্ভর রয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিন মাস আগে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে নগরীতে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন তিনি। তবে তিনি চ্যালেঞ্জ ও নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছেন। দীর্ঘদিন সিলেটের মাঠে থাকা মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তাঁকে দেখছেন বাঁকা চোখে। আলোচনায় রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনসহ আরও দু’জন।
আওয়ামী লীগে মেয়র পদে প্রার্থীসংখ্যা দীর্ঘ হলেও বিএনপিতে নাতিদীর্ঘ। এসব প্রার্থীর মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। দলীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও আরিফুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নাগরিক কমিটির ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর দেখাও করেছেন। মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য যুবদলের আলোচনা ও ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে আরিফ বলেন, দল নির্বাচনে যাবে না। তাই আমার নির্বাচন করার প্রশ্ন ওঠে না।
সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের একক আধিপত্যের নেতা। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে এসেই সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। নগর কমিটির সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতারাও তাঁর কথার বাইরে যান না। তবে তাঁর আধিপত্য ভেঙেছেন তাঁর বৃহত্তর পরিবারের সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর ভাগনে ও সাদিক আবদুল্লাহর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত দলীয় মনোনয়ন চেয়ে সাদিক আবদুল্লাহকে প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুবলীগ-সাবেক ছাত্রলীগ ও ব্যবসায়ী নেতাসহ আরও ছয়জন। তাঁরাও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, আবেদনকারী সবাইকে বিভিন্ন সময়ে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ক্ষতি করেছেন। তাঁরা মেয়রের উন্নয়ন ব্যর্থতা, দলকে কুক্ষিগত করা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ সামনে আনছেন। এসব নিয়ে নগরীতে চলছে নানা গুঞ্জন। নগর আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র দাপুটে নেতা সাদিক আবদুল্লাহ দ্বিতীয়বার দলের মনোনয়ন পাবেন কিনা– সেটাই এখন নগরবাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও কৌতূহলের বিষয়।
অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন– শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মীর আমিন উদ্দিন মোহন, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন, বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান প্রমুখ। খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘বরিশালে সুস্থধারার রাজনীতি নেই, উন্নয়ন নেই। এতে হতাশাগ্রস্ত বরিশালবাসীকে আশার আলো দেখাতে আমি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দলের কাছে এই প্রথম কিছু চাইলাম। আশা করি, আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে নিরাশ করবেন না।’ প্রার্থী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মীর মোহন বলেন, ‘মেয়র সাদিক দিনে ঘুমান, রাতে জেগে থাকেন। তাঁর লেখাপড়া জানা নেই, ফেসবুক লাইভে সারাদিন নিজের ও পারিবারিক বন্দনা করেন। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী ফুফুর বন্দনা করেন। সবকিছু মিলিয়ে মেয়র নগরীতে একটি ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। এর অবসান ঘটাতে মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছি।’
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক ছাড়াও মনোনয়ন চেয়েছেন আওয়ামী লীগের তিন নেতা। তবে তালুকদার খালেককে আবারও প্রার্থিতার বিষয়ে দলের হাইকমান্ড গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে বলে নেতারা দাবি করছেন। মেয়র পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তবে দল নির্বাচনে না গেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন না। এদিকে এরই মধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ছাড়া মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন আরও দু’জন। মেয়র খালেক আবারও নির্বাচন করতে আগ্রহী। গত ১১ এপ্রিল তিনি দলের মনোনয়ন ফরম পূরণ করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া দলের কাছে মনোনয়ন চেয়েছেন খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য রুনু ইকবাল বিথার।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা জানান, দক্ষিণাঞ্চলের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল এরই মধ্যে বর্তমান মেয়র তালুকদার খালেককে নির্বাচন করার ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী খুলনা সফরকালে তালুকদার খালেককে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। তাঁর প্রার্থিতার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে আছে, শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি রয়েছে।
মেয়র খালেক বলেন, দলের যে কেউই মনোনয়ন চাইতে পারে, এ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলেন, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে আশাবাদী। আমি অনেক আগে থেকেই খুলনা নগরীর দুই সংসদ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছি।
রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এবারও নৌকার প্রার্থী হচ্ছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। নির্বাচনী প্রচারণায় নামার অংশ হিসেবে তিনি ওমরাহ পালন শেষে গত শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন। রোববার সংসদ ভবনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। দলীয় প্রধানের সবুজ সংকেত পেয়ে পরদিন গত সোমবার লিটনের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন উত্তোলন করা হয়।
এদিকে, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহফুজুল আলম লোটন এবং সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বুধবার। খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, মনোনয়ন বোর্ড যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, তবে নির্বাচন করব। নির্বাচনের জন্য আমরা দলীয়ভাবেই প্রস্তুত আছি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে। এতে অন্য দলগুলোর তেমন ভূমিকা থাকে না। তবে এবার বিএনপি ভোটে না এলে যিনি দলটির সমর্থন পাবেন, তিনিই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন।
আরো পড়ুন : রহমতের আর মাগফেরাতের পর নাজাত লাভের দিন শুরু