পিচঢালাই শেষ হবে মার্চে পদ্মা সেতু চালু হবে জুনের শেষ সপ্তাহে

অর্থনীতি জাতীয় প্রচ্ছদ ভ্রমণ মুক্তমত সফলতার গল্প হ্যালোআড্ডা

যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে পদ্মা সেতুতে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আগামী পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই সেতুটি চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য জুনের শেষ সপ্তাহে পদ্মা সেতু চালু করে দেশবাসীকে ঈদের ‘উপহার’ দিতে পুরো কাজ এগোচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এর ফলে ঈদে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরমুখী মানুষের যাতায়াতও আনন্দদায়ক হবে।

সরকার ও সেতু বিভাগের সূত্র পদ্মা সেতু চালুর বিষয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র বলছে, পদ্মা সেতু চালুর আনুষ্ঠানিক কোনো তারিখ ঠিক করা হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো পর্যায় থেকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন সেতুটি চালুর আগ্রহ দেখানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নকশায় দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফার মতো করে সেতুটি আলোকসজ্জিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ বিশেষ দিনে আলো দিয়ে সজ্জিত করার লক্ষ্যেই এই পরিকল্পনা। এটি আর্কিটেকচারাল লাইটিং নামে পরিচিত। তবে কারিগরি জটিলতার কারণে জুনের মধ্যে এই কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে এই আলোকসজ্জার ব্যবস্থা ছাড়াই সেতুটি চালু করা হবে। তবে ল্যাম্পপোস্টের মাধ্যমে নান্দনিকভাবে সড়কবাতি থাকবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাকি সাড়ে তিন শতাংশ কাজের মধ্যে রয়েছে নিচ দিয়ে গ্যাসের পাইপলাইন বসানো, রেলপথের পাশে হাঁটার রাস্তা তৈরি। যানবাহন চলাচল করার জন্য দরকারি কাজ হচ্ছে পিচঢালাই ও সড়কবাতি বসানো। পাশাপাশি সড়কের সাইন–সংকেত ও মার্কিং বসাতে হবে।

এর বাইরে নদীশাসনের কাজও কিছুটা বাকি থাকবে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কাজ এগিয়েছে ৮৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯১ শতাংশ। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আর্কিটেকচারাল লাইটিং এবং নদীশাসনের বাকি কাজের জন্য যানবাহন চালু করতে কোনো বাধা নেই।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোন তারিখে পদ্মা সেতু চালু হবে—এটা সরকারের নীতনির্ধারকেরা ঠিক করবেন। তবে জুনের মধ্যে কাজ শেষ করে চালু করার লক্ষ্য নিয়ে সব কিছু এগোচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, জুনেই সেতু চালু হবে। তিনি বলেন, এখন জটিল কোনো কাজ নেই। যা আছে সবই মসৃণ-সাজসজ্জার কাজ।

ঠিকাদার সূত্রে জানা গেছে, সেতুর সাজসজ্জার কাজ ২৩ মের মধ্যে শেষ হতে পারে।

পিচঢালাই শেষ হবে মার্চে: প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, সেতুতে পিচঢালাইয়ের কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই পিচঢালাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। সেতুতে প্রথম পানিনিরোধক একটা পাতলা স্তর বা ওয়াটার মেমব্রেন বসানো হয়েছে। এর ওপর দুই স্তরের ১০০ মিলিমিটার পুরো পিচঢালাই হচ্ছে।

পিচঢালাই শেষ হলে সেতুতে সাইন–সংকেত এবং মার্কিংয়ের কাজ শুরু হবে। সেতুতে ৭১৫টি সড়কবাতি (ল্যাম্পপোস্ট) বসানো হবে। এর মধ্যে ১০০টি বসেছে। মে মাসের মধ্যে এই কাজ শেষ হবে।

এর বাইরে সেতুর নিচ দিয়ে মনোরেল বসানো হচ্ছে। নিচের অংশে মেরামত দরকার হলে এই মনোরেলের মাধ্যমে চলাচল করতে পারবেন কর্মীরা। আর সেতুর ওপরের ও পাশে মেরামতের জন্য গ্যান্ট্রি ইতিমধ্যে এসেছে।

সেতুর দুই পাশে টোলপ্লাজা বসানোর কাজ ২০১৮ সালেই শেষ হয়েছে। তবে এতে সফটওয়্যার ও স্বয়ংক্রিয় অন্যান্য ব্যবস্থা যুক্ত করতে হবে। এই কাজ করবে মূলত টোল আদায়ের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের (যৌথ) দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর–কষাকষি চলছে।

বড় কাজ সব হয়ে গেছে: সেতুর কাজ তদারকিতে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, কারিগরিভাবে জটিল আর কোনো কাজ বাকি নেই। ভারী যন্ত্রের ব্যবহারও নেই বললেই চলে। সর্বশেষ বড় কাজ ছিল জোড়া বা মুভমেন্ট জয়েন্ট বসানো। সেতু ও ভায়াডাক্ট (ডাঙার অংশ) মিলে ২৮টি এমন জোড়া রয়েছে। মূলত তাপ-চাপের কারণে সব সেতুরই বিভিন্ন অংশ সংকোচন-সম্প্রসারণ ঘটে। এ জন্য প্রতিটি অংশে কিছুটা ফাঁকা রাখা হয়। এগুলোতে নানা ধরনের বিয়ারিং ও কলকবজা বসিয়ে জোড়া দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু কংক্রিট ও স্টিলের সংমিশ্রণে বলে সংকোচন-সম্প্রসারণ আরও বেশি হবে। মূলত সংকোচন-সম্প্রসারণের কারণে সেতুর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, এ জন্যই এসব জোড়া রাখা হয়।

এ ছাড়া সেতুতে ভূমিকম্প প্রতিরোধক বিয়ারিংও লাগানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতুতে স্থাপন করা এসব বিয়ারিং প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতুটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে।

মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের শেষের দিকে। এরপর খুঁটির ওপর স্টিলের প্রথম স্প্যানটি বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সর্বশেষ অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এর মাধ্যমে পদ্মা নদীর দুই পার সরাসরি যুক্ত হয়ে যায়। এরপর সেতুতে কংক্রিটের স্ল্যাব বসিয়ে জোড়া দেওয়া হয়।

পদ্মার মূল সেতু অর্থাৎ নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। অবশ্য দুই পারে আরও প্রায় চার কিলোমিটার আছে ভায়াডাক্ট। সব মিলিয়ে সেতুটি প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ।

দ্বিতলবিশিষ্ট সেতুর স্টিলের স্প্যানের ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এই পথটি ২২ মিটার চওড়া, চার লেনের। মাঝখানে আছে বিভাজক। স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুতে একটি রেললাইনই বসানো হবে। তবে এখনো এই কাজ শুরু হয়নি। এই কাজ করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ আলাদা প্রকল্প নিয়েছে।

পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই দিয়ে এই অপেক্ষার শুরু। এর মাঝখানে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে জটিলতা স্বপ্নের সেতুর ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়ে। এর মধ্যে সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্যয় ও সেতুর প্রভাব: ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বর্তমানে কয়েক দফা সময় বৃদ্ধির পর এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।

সমীক্ষায় এসেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে, সহজ হবে মানুষের চলাচলও।

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *