বঙ্গবাজার মার্কেট। ছিল হাজারো ব্যবসায়ীর রুটি-রুজির ঠিকানা। মঙ্গলবার আগুনে ভস্মীভূত হয় পুরো বঙ্গবাজার। সব হারিয়ে কাঁদছেন ব্যবসায়ীরা। তবে আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কারা চালাতো বঙ্গবাজার?। কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিশাল এ মার্কেট। মালিকানা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কেউ বলেন বঙ্গবাজার মার্কেটের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আবার কেউ বলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে।
দোকান মালিকরা কেউ কেউ বলছেন তাদের দলিলমূলে কেনা সম্পত্তি। অন্যদিকে দোকান মালিক সমিতি বলছেন ইজারা নেয়া সম্পত্তি। সরজমিন জানা যায়, পুড়ে যাওয়ার আগে বঙ্গবাজার মার্কেটের জায়গাটির মালিকানা একাধিকবার হাতবদল হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী একটির বেশি কেউ দোকান বরাদ্দ না পেলেও মালিকানা বদলাতে বদলাতে অনেকে ৪ থেকে ৫টি দোকানের মালিক হয়েছেন। এমনটিই বলছেন দোকান মালিক সমিতির অফিস সহায়ক আব্দুর রহমান। তাহলে জায়গার প্রকৃত মালিক কে? বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির পুরোনো কাগজপত্র বলছে, ১৯৭৫ সালের আগে মার্কেটের এই জায়গাটি ছিল রেলওয়ে কলোনি। মালিক ছিল রেলওয়ে। এখানে রেলের যন্ত্রপাতি রাখা হতো। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায়, ১৯৭৯ সালে রেলওয়ে জায়গাটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। বছর খানেক সিটি করপোরেশন এই জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে আশপাশের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা জায়গাটি পেতে চেষ্টা চালান। সিটি করপোরেশনের কাছে লিখিত আবেদনও করেন তারা। মানবিক বিবেচনায় তৎকালীন মেয়র কর্নেল (অব.) আব্দুল মালেক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসাতে অনুমতি দেন। পরে ব্যবসায়ীরা টিনশেডের কয়েকশ’ দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা শুরু করেন। চারটি ইউনিটে ভাগ করে দোকান নির্মাণ করা হয়। তবে ১৯৯৫ সালে ভয়াবহ আগুনে ভস্মীভূত হয় পুরো বঙ্গবাজার মার্কেট। তখন ব্যবসায়ীরা বঙ্গবাজার ছেড়ে ঢাকা ট্রেড সেন্টার ও সুন্দরবন মার্কেটে চলে যান। ১৯৯৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নিজ উদ্যোগে তাদের ফিরিয়ে এনে বঙ্গবাজারে পুনর্বাসন করেন। ওই সময় জায়গাটি ভিটা অনুসারে ব্যবসায়ীদের কাছে নামমাত্র দামে বরাদ্দও দেন। প্রথমে জন প্রতি ২০ হাজার টাকা সালামি নিয়ে বঙ্গ কমপ্লেক্সে ২৯৬১ জনকে একটি করে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এ বরাদ্দ দেয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে দ্বিতীয় দফায় আবার ২৩৭০টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। তখন ১ লাখ টাকা করে সালামি নেয়া হয়। ২০১৪ সালে আবারো যাচাই-বাছাই করে ৫৯১ জনকে একটি করে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। সিটি করপোরেশন বরাদ্দ দেয়া এসব দোকান থেকে প্রতি বছর সালামি তোলেন। স্কয়ার ফিট ১৭ টাকা হিসাবে। বছরের শুরুতেই এ টাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি দোকান প্রায় ১৫ থেকে ৭০ স্কয়ার ফিট পর্যন্ত। তবে পাশের এনেক্সকো টাওয়ারের জায়গার মালিক এখনো রেলওয়েই আছে। এমনটিই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির অফিস সহায়ক আব্দুর রহমান বলেন, এখানে জন প্রতি একটার বেশি দোকান বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। এক ব্যক্তি একাধিক দোকান নিতে পারেন না। আর সিটি করপোরেশন কোনো ভিটি স্থায়ীভাবে বিক্রি করেন নাই। তারা শুধু ইজারা দিয়েছে। তবে বরাদ্দের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। বরাদ্দ হয়েছে লটারির মাধ্যমে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, যারা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের অনেকেই দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। তখন কেউ কেউ একাধিক দোকান কিনেছেন। বেচাকেনা এখনো অব্যাহত আছে। এক একটা দোকান একাধিক মালিকানা বদল হয়েছে। বিক্রি অব্যাহত থাকায় বর্তমানে কারও কারও ৩ থেকে ৪টা দোকান হয়েছে। তবে একজনের ৪ থেকে ৫টার বেশি দোকান নাই। এক একটি দোকান কোনো গলিতে ১৫ থেকে ২০ লাখ আবার কোনো গলিতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বরাদ্দ নেয়ার সময় সিটি করপোরেশন কোনো স্থাপনা তৈরি করে দেয়নি। হলফনামায়ও এটা উল্লেখ ছিল না।
সূত্রমতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বঙ্গবাজার মার্কেটের জায়গা খালি করতে একাধিকবার নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশে জায়গাটি সিটি করপোরেশনের বলে দাবি করা হয়। তবে ব্যবসায়ীরা ওই নোটিশের গুরুত্ব দেয়নি। এ নিয়ে দোকান মালিক সমিতি ও সিটি করপোরেশনের মাঝে কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়। তবে ২০১৭ সালে কঠোর অবস্থানে যায় সিটি করপোরেশন। ২ মাসের মধ্যে জায়গা খালি না করলে উচ্ছেদের ঘোষণা দেন। পরে ওই বছরের শেষের দিকে দোকান মালিকরা সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন।
দোকান মালিক সমিতির সদস্য হাজী ফারুকুল ইসলাম মনু বলেন, ২০১৭ সালে মেয়র সাঈদ খোকনের সময়ে উচ্ছেদের নোটিশ করেছিল। নোটিশে বলেছিল আমরা মার্কেট পাকা করবো আপনারা জায়গা খালি করেন। তখন আমরা বলেছি, তারা মার্কেট পাকা করবেন। আমরা রাজি ছিলাম। কিন্তু তারা জায়গা ফাঁকা করে বছরের পর বছর ফেলে রাখবেন, কাজ করবেন না। তাহলে ব্যবসায়ীরা যাবে কোথায়। আমরা ভরসা পাই না। নির্মাণের পরে তারা আমাদের সাময়িক বরাদ্দপত্র দিতে চেয়েছিল। তবে এতে আমরা রাজি হয়নি। পরবর্তীতে তারা আবারো একটা নোটিশ দিলো জায়গা খালি করতে। উপায় না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হই। পরে হাইকোর্ট ২০১৭ সালে মামলা আমলে নিয়ে এই জায়গার উপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। এবং সিটি করপোরেশনের নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন।
বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, মালিক সমিতি এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবে। আপাতত অগ্নিকা- নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। সংবাদ সম্মেলনেই বিস্তারিত বলা হবে।
বঙ্গবাজার ৮০৯৬ নং রাফা গার্মেন্টের দোকান মালিক সাইদুর রহমান বলেন, আমার দোকান কেনা সাদেক হোসেন খোকার সময়ে। তখন ১ লাখ টাকা নিয়ে সিটি করপোরেশন আমাকে এই জায়গা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে আরও অনেকে বরাদ্দ নিয়েছিলো। সময়টা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে হবে। আমার দোকানটি ভাড়া দেয়া ছিল। ১০ লাখ টাকা অগ্রিম এবং ভাড়া প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা। আমার মনে হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেয়া হলো। এখন জায়গা ফিরে পাবো কিনা তা নিয়েও শঙ্কা আছে।
বঙ্গবাজার মার্কেটের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের সমন্বয়ক মো. রুস্তম ব্যাপারি বলেন, একমাত্র দোকান মালিক সমিতির নেতাদের কারও কারও ৪ থেকে ৫টা দোকান আছে। তারা বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কিনেছেন।
আরো পড়ুন : আগুনের ঝুঁকিতে ঢাকার ৪৫০টি মার্কেট ও শপিংমল