সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। চলতি বছরেই অন্তত ১০টি ভূমিকম্প হয়েছে দেশে। এ ছাড়া গত এক বছরে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎস রয়েছে। একটা হচ্ছে সাবডাকশন জোন- যেটি সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত। আরেকটা ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত। যেটি সুনামগঞ্জ থেকে জাফলং পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক সাবডাকশন জোন। যেখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা আছে। যেকোনো সময় ওই ভূমিকম্প দেশে বড় ধরনের ডিজাস্টার তৈরি করতে পারে।
তাই সংশ্লিষ্টদের পূর্বপ্রস্তুতি ও করণীয় ঠিক করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকে ডিসেন্ট্রালাইজড করার কথা বলছেন তারা। অন্যথায় এটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হতে পারে। সর্বশেষ ভূমিকম্প হয়েছে ১৭ই সেপ্টেম্বর। ৪.২ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের উৎস ছিল ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশ তিনটা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। সেগুলো হলো- ভারত, এশিয়া ও বার্মা প্লেট। ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। যেটা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। এর পূর্ব দিকটা বার্মা প্লেটে আর পশ্চিম দিকটা ভারতের প্লেটে অবস্থিত। ভারতীয় প্লেটটা বার্মা প্লেটের নিচে সংযোগ বরাবর তলিয়ে যাচ্ছে। এ রকম একটা ভূ-গাঠনিক কাঠামোর মধ্যে ভূমিকম্প হবে এটাই স্বাভাবিক।
এ ভূতত্ত্ববিদ আরও বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ভেরি লো ভালনারেবল এরিয়া। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভূমিকম্প প্রবণতার দিক দিয়ে এর মান খুবই নিচের দিকে। এটা হচ্ছে আরও বিপজ্জনক। ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার যতগুলো উপাদান তার সবই এখানে আছে; ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মনে করেন দুইটা বা তিনটা প্লেটের সংযোগস্থলে যে পরিমাণ ভূমিকম্প হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না। সে হিসেবে ভূমিকম্পের প্রবণতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুবই নিচের দিকে আছে। এটাই হচ্ছে বিপজ্জনক। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ দিয়ে যে কাল্পনিক রেখা সেখানে ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেট আটকে আছে। এখানে সুইচ করতে পারছে না। সুইচ করলেই কেবল ভূমিকম্প হবে। আটকে থাকার কারণে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা হিসাব করেছি ৮০০ থেকে ১০০০ বছর ধরে এ শক্তিটা জমা হয়ে আছে। হাজার বছর আগে যে শক্তিটা ছিল সেটা বের হয়ে গেছে ভূমিকম্প হয়ে। এরপর নতুন করে শক্তি জমা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভূমিকম্পের উৎস দূরে হলেও সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকায়। কারণ এখানে ঘনবসতি, অপরিকল্পিত-অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সরকারের প্রস্তুতির অভাব। সবগুলো উপাদানের দিক দিয়ে এখানে ঝুঁকির পরিমাণটা বেশি। কী ক্ষতি হবে তা কল্পনার বাইরে। ওই রকম ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সরকার হয়তো বাধ্য হবে এটাকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে। কারণ আমাদের এখানে ডিসেন্ট্রালাইনজ করার পরিকল্পনা নেই। এছাড়া সব ঢাকায়। আমরা যদি পশ্চিমাঞ্চলে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে পারি তাহলে ঢাকার ক্ষতি হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
তবে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি দেখেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে ভূমিকম্প যে এলাকায় হয় আমরা এমন একটা অঞ্চলে অবস্থান করছি। তাই এখানে ভূমিকম্প হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘ সময় যদি এখানে ভূমিকম্প না হয় সেটা অস্বাভাবিক। আবার যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে ওই এলাকায় যে শক্তিটা সঞ্চিত হয়েছে তা বের হয়ে যায়। এ ধরনের ভূমিকম্প আগেও হয়েছে। তবে চলতি বছর হয়তো একটু বেশি হচ্ছে। এ জন্য আমি বলতে পারি না এখানে একটা বড় ভূমিকম্প হবে। তিনি বলেন, এটা স্ট্যাডির ব্যাপার। এখানে যদি ভূমিকম্পের সোর্স থাকে সেটির ইতিহাস দেখে আমি বলতে পারবো আগে ক’বার হয়েছে কতো বছর পর পর হয়েছে। এ রেকর্ড যদি আমি এনালাইসিস করে বের করতে পারি তাহলে আমি বলতে পারি যে, একশ’ বছর পার হয়ে গেছে বাকি একশ’ বছর পর একটা ভূমিকম্প হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো স্টাডি বা সোর্স অব রেকর্ডও এখানে নেই। আশেপাশে এ ধরনের বড় কোনো সোর্স আমরা পাইনি। তাই বড় ভূমিকম্প হবে এটা আমরা বলতে পারি না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরের আশেপাশে বড় দুটি ভূমিকম্প হয়েছে- একটি ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জের দিকে, অন্যটি ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে। এসব ভূমিকম্পে ওইসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিছুটা তবে ঢাকা শহরে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
আরেকটা বড় ভূমিকম্পের সোর্স হচ্ছে আমাদের ইস্টার্ন বাউন্ডারি যেটি বার্মা এবং মণিপুর ও আসামের মেঘালয়ের এরিয়া। এখানে বড় ভূমিকম্প ও ঘনঘন ভূমিকম্প হয়। আমরা যদি ভূমিকম্পগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো বেশির ভাগ ভূমিকম্পের উৎসই এসব এলাকায়। এর থেকে যদি আমরা পশ্চিম দিকে আসি তাহলে দেখবো আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আপনি যদি যশোর এলাকার দিকে যান তাহলে দেখবেন ভূমিকম্প ওদিকে হয় না বললেই চলে। আমাদের এখানে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়ার মতোই অবস্থা আছে। বড় ভূমিকম্পের সোর্স যেগুলো আছে সেগুলো সাধারণত ৩০০-৪০০ বছরের মধ্যে হয়নি। ড. জিল্লুর রহমান বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্লেটের ভেতরে যদি কোনো ফল্ট থাকে যেগুলোকে আমরা বলি সেলোয়ার/ক্র্যাস্টাল ফল্ট যা ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে। এ ভূমিকম্পগুলো ৭ মাত্রার বা তার ঊর্ধ্বে হতে হলে আরও ৩০০ থেকে ৪০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, যে ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে এগুলো কোনো লিনিয়ার ফলো করে না। এটা বিভিন্ন সোর্সে হয়েছে। এ জন্য আমি বলতে পারি না এ ভূমিকম্পগুলো বড় ধরনের ভূমিকম্পের আলামত। বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস তখনই হবে যখন সেটি কোনো সোর্সকে ফলো করে। বরং আমরা বলতে পারি এখানে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে এর ফলে এখানে যে শক্তির সঞ্চার হয়েছে তা রিলিজ বা নিঃসরণ হচ্ছে। যদি রিলিজ না হতো তাহলে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো।
আরো পড়ুন : ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায় বিশ্ব ক্রমে অস্থির হয়ে উঠেছে