সিআইডির সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আকসাদুদ-জামান ডাকাতিতে ব্যবহার করতেন সিআইডির গাড়ি। চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যসহ নয়জনকে নিয়ে তিনি ডাকাতের দল গড়ে তুলেছিলেন। এসআই আকসাদুদের বিরুদ্ধে হওয়া ডাকাতির মামলার অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) গত বৃহস্পতিবার আকসাদুদসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে ওই অভিযোগপত্র দেয়।
ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশি অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আজ রোববার বিকেলে বলেন, আকসাদুদসহ নয়জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন আকসাদুদ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত থাকাকালে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিয়োগ করা ‘রাইটার’ মোশাররফ হোসেন, চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য হাসান রাজা, ডাকাত চক্রের সদস্য সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া শিকদার, মনির হোসেন ও মিলন মিয়া। অভিযোগপত্রভুক্ত মনির ও মিলন পলাতক। আকসাদুদসহ সাতজন গ্রেপ্তার হলেও সম্প্রতি কারাগার থেকে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন। অভিযোগপত্রভুক্ত চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য হাসান রাজা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। আসামিদের মধ্যে হাসান রাজার বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তিনটি এবং সেলিম মোল্লার বিরুদ্ধে চারটি ডাকাতির মামলা রয়েছে। আরেক সহযোগী রিপন মোড়ল মাদারীপুরে একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর সকালে বিমানবন্দর সড়কের কাওলায় দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া ও তাঁর ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে ডিবি পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের মারধর করে সঙ্গে থাকা পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, দুই হাজার দিরহাম, মুঠোফোন, কাপড়ভর্তি লাগেজসহ মালামাল ডাকাতি করে তাঁদের পাশের জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। সৌদি আরবে রোমানের কাপড়ের ব্যবসা আছে। জমিজমা বিক্রি করে ওই টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তির সহায়তায় ছয় ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য হাসান রাজার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আকসাদুদের নাম আসে। ডাকাতিতে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের চালক হারুন অর রশিদ ওরফে সজীব, অটোরিকশাচালক জোনাব আলী এবং কায়ছার মাহমুদ ওরফে জাকির হোসেন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, এসআই আকসাদুদ ডাকাতির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তিনি ২০১৩ সালে ডিএমপিতে কর্মরত থাকাকালে মতিঝিল অঞ্চলের একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারকে মাথায় অস্ত্র ঠেকান। এ ছাড়া কর্তব্যরত থাকাকালে আরেকবার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তিনি। এর দায়ে দুবার বিভাগীয় শাস্তি ভোগ করেন আকসাদুদ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই মাকসুদুল ইসলাম বলেন, বিমানবন্দর এলাকাকেন্দ্রিক সংঘটিত অধিকাংশ ডাকাতি আকসাদুদের নেতৃত্বে হয়েছে। সিআইডি কর্তৃপক্ষের অগোচরে তিনি সিআইডির গাড়ি ডাকাতিতে ব্যবহার করতেন। সিআইডি কর্তৃপক্ষ মাসিক চুক্তিতে এ গাড়ি ভাড়া করেছিল।
ডাকাতির ওই ঘটনায় ডিবি পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ১৮ আগস্ট আকসাদুদকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিআইডি। পরে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আকসাদুদের স্ত্রীর সঙ্গে এক ব্যক্তির ১ কোটি ২৮ লাখ ও ১৪ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই দিন রাতে রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে আকসাদুদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিওতে এক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?’ অপর প্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠও টাকা কোনো এক স্যারকে দেওয়ার কথা বলছিলেন। পরে জানা যায়, নারী কণ্ঠটি এসআই আকসাদুদের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের।
তাহমিনার দাবি, অপর প্রান্তের কণ্ঠটি ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশির। তাঁর স্বামীকে ডাকাতির মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে তিনি ওই টাকা ডিবি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছিলেন। অবশ্য কায়সার রিজভী কোরায়েশি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ওই কথোপকথন তাঁর নয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আকসাদুদের ডাকাতির ঘটনার আরেকটি অডিও ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে সোর্স (তথ্যদাতা) আমির আকসাদুদকে ১২ লাখ টাকা ডাকাতি করার প্রস্তাব দেন। এ সময় আকসাদুদকে বলতে শোনা যায়, ২০ লাখের নিচে কোনো কাজ করবেন না তিনি।
আকসাদুদকে গ্রেপ্তারের পর ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছিলেন, টাকা লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আজ রাতে যোগাযোগ করা হলে ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তর তদন্ত করছে।
আরো পড়ুন : পদ্মা নদীর নামে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম পেল ‘পদ্মা সেতু’