এক দিন পরই ঘোষিত হচ্ছে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। এবারের বাজেটে সরকারের ব্যয়ের ধরন মোটামুটি গতানুগতিক থাকছে। তবে রাজস্ব আয় বাড়াতে করের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে করনীতি ও কর প্রশাসনে বেশ কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কয়েকটি খাতে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়া হবে। কিছু ক্ষেত্রে করছাড় থাকবে না এবং কিছু ক্ষেত্রে কমবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাহার করা হবে। নতুন করদাতা যুক্ত করা বা করের জাল বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ থাকবে। ভ্যাটের হার ও আওতাও বাড়ানো হবে। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের একটি বড় অংশ নতুন করে আরও চাপে পড়তে পারে বলে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ঋণ করে খরচ করা হবে। ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শীর্ষক নতুন বাজেটের অর্থবিলে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও। তবে অর্থমন্ত্রী এসব সংস্কারের সঙ্গে আইএমএফের শর্তের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে কিছু বলবেন না বলে জানা গেছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু আইএমএফের শর্তের কারণে নয়, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সরকারের চেষ্টা আগে থেকেই আছে। আগামী অর্থবছরে ওই চেষ্টা ত্বরান্বিত হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণের সঙ্গে রাজস্ব খাতে সংস্কারের শর্ত রয়েছে। অন্যতম শর্ত হলো আগামী অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। তবে আমদানি ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকায় আমদানি শুল্ক থেকে খুব বেশি রাজস্ব আসবে না। এ কারণে আয়কর এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে গতি না বাড়লে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ কঠিন হবে।
এনবিআর অবশ্য আইএমএফকে জানিয়েছে, যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় তাহলে প্রত্যাশিত কর আদায় সম্ভব হবে। বাড়তি কর আদায়ের জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, লজিস্টিকস সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রসঙ্গত, আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে সীমিত রাখতে চায় সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই কঠিন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের মতে, রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতা খুঁজতে হবে। তবে করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তির কাছ থেকে আয়কর আদায় করা অন্যায় হবে। তিনি আরও বলেন, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কর আদায় ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে বাড়তি কর আদায় করা সম্ভব হবে। কর সংগ্রহ পদ্ধতি আরও সহজ ও গ্রাহকবান্ধব করতে হবে। কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। আর জরুরি খাত ছাড়া কর অব্যাহতি তুলে দিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্বের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে; রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তবে কোনো খাতে যেন অযৌক্তিকভাবে কর আরোপ করা না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। জনগণকে চাপে না ফেলে রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
করজাল বাড়বে
বর্তমানে দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন সনদধারীর সংখ্যা প্রায় ৮৬ লাখ। মাত্র ৩২ লাখ ব্যক্তি আয়কর রিটার্ন জমা দেন। এর মধ্যে প্রায় আট লাখের করযোগ্য আয় নেই। রিটার্ন দাখিল বাড়ানোর পদক্ষেপের ঘোষণা থাকবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে। করযোগ্য আয় না থাকলেও বিভিন্ন সেবা নিতে কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র যাঁরা নেবেন, তাঁদের ওপর কর আরোপ করা হতে পারে। প্রমাণপত্র পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপ হতে পারে। বর্তমানে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগসহ ৩৮ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র লাগে। আগামী অর্থবছরে এর সঙ্গে আরও ছয় ধরনের সেবা যুক্ত হতে পারে।
আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে টিআইএনধারীর সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করতে চায় রাজস্ব বোর্ড। এ জন্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এনবিআরের শাখা কার্যালয় স্থাপন ও জনবল নিয়োগের মাধ্যমে নতুন করদাতা শনাক্ত করা হবে। এ ছাড়া আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী স্কিম গ্রহণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের করদাতাদের সহজে কর প্রদানসহ রিটার্ন দাখিলে উদ্বুদ্ধ করা হবে। কর আদায়ে সহযোগিতা করার জন্য বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগেরও পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের।
কর অব্যাহতি ও ছাড় কমবে
এনবিআরের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শিল্প উদ্যোগ, আমদানি প্রতিস্থাপন কারখানা, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা ধরে রাখা, নিত্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব কর অব্যাহতি রয়েছে, তা জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
আইএমএফ বলেছে, যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দিয়ে অর্থনীতির তেমন উপকার হচ্ছে না, সেখান থেকে অব্যাহতি তুলে দিতে হবে।
সম্প্রতি এনবিআর আইএমএফকে জানিয়েছে, এরই মধ্যে কিছু অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ থাকবে। বেশ কিছু অব্যাহতির ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে। মেয়াদ শেষ হলে সেগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নতুন ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ হচ্ছে, কোথাও কোথাও বাড়বে
বর্তমানে কয়েকটি হারে যেমন– ৫, সাড়ে ৭, ১০ এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। সরকার আইএমএফকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, এই স্তর কমিয়ে আনা হবে। নতুন বাজেটে এ বিষয়ে ঘোষণা থাকবে। নতুন কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে ভ্যাট আরোপ হতে পারে আগামী বাজেটে। যেমন– মোবাইল ফোন উৎপাদন পর্যায়ে এখন ভ্যাট নেই। এক্ষেত্রে ২ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হতে পারে। এর বাইরে মোবাইল ফোন সংযোজনে ভ্যাট বাড়তে পারে। স্থানীয় এলপিজি সিলিন্ডারের মূল কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে সিলিন্ডার উৎপাদনকারীদের বিদ্যমান ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হতে পারে। সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্কও কিছুটা বাড়তে পারে।
কার্বনেটেড পানীয় শিল্পের (বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি) ওপর বিদ্যমান টার্নওভার করের হার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ, যা নতুন বাজেটে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের আওতায় বিনিয়োগকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ১ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ হতে পারে। নির্মাণসামগ্রীর উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়তে পারে। শিল্পে যানবাহন আমদানিতে শুল্কছাড় উঠিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বচ্ছতার সঙ্গে ভ্যাট আদায়ে ২০২৬ সালের মধ্যে তিন লাখ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী অর্থবছরে স্থাপন করা হবে ৬০ হাজার ইএফডি।
বর্তমানে কলম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। আগামী বাজেটে এ খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হতে পারে। প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। একইভাবে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালিসামগ্রী ও তৈজষপত্রের ভ্যাট হার বাড়ানো হতে পারে। কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনেও ভ্যাটের হার বাড়ানো হতে পারে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ফি বা সেবা মাশুল আগামী বাজেটে বাড়তে পারে। জমির নামজারি ফি, হাটবাজারের ইজারামূল্য, চিড়িয়াখানার প্রবেশমূল্য, এমনকি রেশনে দেওয়া চাল, ডালের দামও বাড়ানো হতে পারে।
বাড়তে পারে ভ্রমণ কর
ভ্রমণ অথবা চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনে বিমান টিকিটের ওপর ভ্রমণ কর বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে আকাশপথে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর আরোপ হতে পারে। বর্তমানে এক্ষেত্রে কোনো কর নেই। বর্তমানে স্থলপথে বিদেশ গমনে ৫০০ টাকা ও নৌপথে ৮০০ টাকা কর বহাল রয়েছে, যা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হতে পারে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে ১ হাজার ২০০ টাকা কর আছে, যা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করা হতে পারে। আকাশপথে সার্কের বাইরে ভ্রমণেও কর বাড়তে পারে।
আরো পড়ুন : ৩১ দফায় ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ বিএনপির অভিন্ন রূপরেখা চূড়ান্ত