নিজস্ব প্রতিবেদক : পোটনকান্ডে সারের সর্বনাশ হয়েছে। ঠিকাদারির নামে মহাকেলেঙ্কারি করেছেন নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন। ২৬ বছর ধরে তিনি দেশের সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেই সুযোগে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার সার গিলে ফেলেছেন তিনি। সার গায়েব নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সরকারি দলের ভিতরেই। পোটন ট্রেডার্সের মালিক হিসেবে কামরুল আশরাফ খান পোটন সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এমন মহাকেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের সাবিক, কাতারের মুনতাজাত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্রোবের কাছ থেকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৪ টন সার কেনে বিসিআইসি। এসব সার বন্দর থেকে গুদামে পৌঁছানোর দায়িত্ব পায় সার পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ড্রাই বাল্ক শিপিং প্রাইভেট লিমিটেডের স্থানীয় প্রতিনিধি পোটন ট্রেডার্স। এ জন্য সরকারের সঙ্গে মোট ১৩টি চুক্তি সই করে পোটন ট্রেডার্স। সৌদি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৪ টন সার বাংলাদেশে এলেও বিসিআইসির গুদামে সরবরাহ করা হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৩২৮ টন। বাকি ৭২ হাজার টন সার বিসিআইসির গুদামে পৌঁছে না দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে পোটন ট্রেডার্স। এসব সারের মূল্য ৫৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। অন্যান্য খরচ ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গিলে ফেলেছেন ৫৮২ কোটি টাকা।
বিসিআইসি ইউরিয়া সার আমদানি ও ব্যবস্থাপনা করলেও টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি (পটাশ) আমদানি ও ব্যবস্থাপনা করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। বিএডিসির সারও পরিবহন করত পোটন ট্রেডার্স। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট সারের চাহিদা ছিল ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। বাকি চার ধরনের সারের চাহিদা ছিল ৩২ লাখ ৮৪ হাজার টন। এর মধ্যে টিএসপি ৭ লাখ ৫০ হাজার, ডিএপি ৯ লাখ এবং এমওপি ৮ লাখ ৫০ হাজার টন। এই চার ধরনের সারের মধ্যে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ টন সারের হদিস নেই। এসব সারের মধ্যে টিএসপি ১৮ হাজার ৭০০ টন, ডিএপি ৩০ হাজার টন এবং এমওপি ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এসব সার বিএডিসিকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও বুঝিয়ে দেয়নি পোটন ট্রেডার্স। পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে সার গায়েবের সত্যতা মিলেছে বিসিআইসির তদন্তেও। সংস্থাটির তদন্তের পর পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে অনুমতি চেয়ে ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিসিআইসি। চিঠিতে বলা হয়েছে, পোটন ট্রেডার্স মৌসুম আসার আগে ২৯ আগস্টের মধ্যে সব ইউরিয়া সার সরকারি গুদামে সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সময়মতো সার সরবরাহ করেনি। কামরুল আশরাফ খানের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেছে বিসিআইসি। তারপরও সার সরবরাহ করেনি। তার আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিসিআইসির যাবতীয় কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পোটন ট্রেডার্সকে। সার সরবরাহ না করায় পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়েছিল বিসিআইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, সরকারের একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা বিসিআইসি কামরুল আশরাফ পোটনকে অভিযুক্ত করার পর তদন্ত হওয়া অপরিহার্য। দেশের স্বার্থে, দুর্নীতি দমনের স্বার্থে তদন্ত করার মূল দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের। তবে বিষয়টি দুর্নীতি দমনকে জানাতে হবে বিসিআইসিকেই। না জানালে দুদককে দোষ দেওয়া যায় না। বিসিআইসির তদন্তে যেহেতু উঠে এসেছে একজন সাবেক সংসদ সদস্য বিপুল পরিমাণ টাকা মেরে দিয়েছেন। বিষয়টি অবশ্যই দুর্নীতি দমনকে জানানো উচিত। সরকার বিসিআইসিকে চাপ দিতে পারে দুদককে জানানোর জন্য। প্রাথমিক দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের। জনগণ এ বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে না। জনগণ চাইবে এত টাকা লোপাট করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সার আমাদের কৃষি ও খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অন্যতম পণ্য। সার নিয়ে যে কোনো ধরনের কারসাজি কঠোর হস্তে দমন করা উচিত। কামরুল আশরাফ খান পোটনের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে।
আরো পড়ুন : নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমার মুসল্লিদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে: আইজিপি