ভোটের গাজীপুর মডেল। কেউ বলছেন, মিশ্র। কারও মতে জনআকাঙ্ক্ষার জয়। বিক্ষুব্ধ, হতাশ ভোটাররা তাদের জবাব দিয়েছেন। বহুদিন হয় তারা কেন্দ্রে যান না। অবাধ এবং নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। গাজীপুরেও যে পুরোটা পেরেছেন তা নয়। সব ভোটার কেন্দ্রে ফেরেনওনি। বাধা ছিল ভোটের আগেই। ছিল ভয়-ভীতি।
তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর তুলনায় ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কিছুটা হলেও বেশি। কী কারণে এমনটা ঘটেছে? বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসানীতির ঘোষণা কি অভয় দিয়েছে ভোটারদের? এতে কী উদ্বুদ্ধ হয়েছেন তারা? গাজীপুরে আসলে কী ঘটেছে। নানা জিজ্ঞাসা। ছেলের ছায়ায় এক মায়ের বিস্ময়কর জয় নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। এ নির্বাচনে বিএনপি এবং সমমনাদলগুলো ছিল না। তবে শুরুতেই সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবং তার মা মনোনয়নপত্র দাখিল করে চমক তৈরি করেন।
ভোটের গাজীপুর মডেলের কিছু বৈশিষ্ট্য এরইমধ্যে আলোচনায় এসেছে।
১. শুরুতে ঋণখেলাপির অভিযোগে ভোটের লড়াই থেকে ছিটকে যান জাহাঙ্গীর আলম। এমনটা হবে হয়তো আগেই আঁচ করেছিলেন তিনি। যে কারণে নিজের মা জায়েদা খাতুনকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রেখেছিলেন।
২. নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ অনুসরণ করে পুরনো মডেল। তার প্রচারণায় হামলা হয়। তার কর্মীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। ভোটের রাতেও তিনি এজেন্টদের আটকের অভিযোগ করেন। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ভোটের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রেই তার মায়ের কোনো এজেন্ট নেই।
৩. ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ। কোথাও তেমন কোনো গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি। ভোটের দিন কাউকে বাধা বা হামলার ঘটনাও ঘটেনি। যদিও ভোটের আগে কয়েকদিনে বাধার ঘটনা দেখা যায়।
৪. ভোটের দিন নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসন অনেকটাই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে।
৫. ইভিএম-এ ভোট গণনায় দীর্ঘ সময় লাগা নিয়ে এবারও নানা গুঞ্জন ও প্রশ্ন দেখা যায়।
৬. ভোটের আগের রাতে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণা ভোটারদের কিছুটা হলেও কেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
৭. শাসক দল বিরোধী বা শাসক দলের প্রতি ক্ষুদ্ধ ভোট পড়েছে জাহাঙ্গীরের মায়ের প্রতীকে।
৮. ভোটের লড়াইটি আসলে হয়েছে আজমত উল্লা বনাম জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে।
৯. দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ নির্বাচন সম্ভব অন্তত ভোটের দিন গাজীপুরে সেটি দেখানোর চেষ্টা ছিল।
ভোটের পর জাহাঙ্গীর আলম এবং তার মা জায়েদা খাতুনের প্রতিক্রিয়াও নজর কেড়েছে। তবে সে আলোচনা পরে। এর আগে পুরনো দিনে কিছুটা চোখ রাখা যায়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান অতিদ্রুত এবং বিস্ময়কর। গত সিটি নির্বাচনে পুরো দলের সমর্থন ছিল তার প্রতি। মেয়র হওয়ার পর গাজীপুরে তিনি তার একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে বিপাকে পড়েন তিনি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নেমে আসে বিপর্যয়। বহিষ্কার হন দল থেকে। হারান মেয়র পদ। তার বিরুদ্ধে আসতে থাকে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। একপর্যায়ে ক্ষমা চেয়ে দলে ফেরার সুযোগ পান। তবে মেয়র পদে আর ফেরা হয়নি। এবার আশা করেছিলেন দলীয় মনোনয়ন পাবেন। তবে তার মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল বিভক্ত। অন্তত দুইজন প্রভাবশালী নেতার সমর্থন ছিল তার প্রতি। তবে আরেকটি অংশ তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আর মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পান আজমত উল্লা। যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ত্যাগী এবং পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত।
মনোনয়ন না পেলেও সুতার ওপর হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন জাহাঙ্গীর আলম। একদিকে মেয়র পদ অন্যদিকে নিজের আরও বড় ভাগ্য বিপর্যয়। ডাক পান দুর্নীতি দমন কমিশনেও। তবে পুরো সময় তিনি পরিস্থিতি সামাল দেন দক্ষতার সঙ্গে। গেল কয়েক বছরে গড়ে ওঠা প্রতিপত্তি কাজে লাগান। আওয়ামী লীগ কর্মীদের একটি অংশকে নিজের দিকে টানেন। আওয়ামী লীগের সহানুভূতি পাওয়ারও চেষ্টা চালিয়ে যান। পুরো পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আনার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, আজমত উল্লার পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ সবসময় তৎপর থাকলেও স্থানীয় কর্মীদের তিনি টানতে পারেননি। সর্বশেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে মার্কিন ভিসা বন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের এমন ঘোষণার পর গাজীপুরে নির্বাচনী পরিবেশ কিছুটা হলেও বদলে যায়। গত কিছু নির্বাচনের তুলনায় এ নির্বাচনে ভোটের হার বেশ বেশি। প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মার্কিন ঘোষণার পরপরই অনেকে ভোট দিতে উদ্ধুদ্ধ হয়েছেন।
ভোটের ফল ঘোষণার পরপরই অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম এবং তার মা জায়েদা খাতুন। জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, নৌকা জিতেছে, ব্যক্তি হেরেছেন। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জায়েদা খাতুন। জয়ের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি নগরের বাসিন্দাদেরও শুভেচ্ছা জানান। জায়েদা খাতুন বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। আমি আমার ভোটের হিসাব পেয়েছি। এই জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রীকে।’ তিনি আরও বলেন- এই বিজয় আমি গাজীপুরবাসীকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেবো।’
গাজীপুরের ভোটের বার্তা পরিষ্কার আবার পরিষ্কার নয়। এখানে সক্রিয় ছিল অনেক হিসাব। এমনিতে আন্দোলনের রাজনীতিতে ঢাকার প্রবেশ মুখ হিসেবে গাজীপুরের গুরুত্ব অনেক। সেই গুরুত্ব বিবেচনাতেই আলোচিত হবে জাহাঙ্গীর আলমের ঘরে ফেরার বিষয়টি। তবে জাতীয় রাজনীতিতে এটি মুখ্য কোনো ইস্যু নয়। বরং নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ঘোষণার প্রভাব কতদূর যায় সেদিকেই দৃষ্টি থাকবে পর্যবেক্ষকদের।
আরো পড়ুন : নওগাঁয় ১৩ গ্রামের জেলে পরিবারের রুটি-রুজি বন্ধের আশঙ্কা প্রভাবশালীদের কারণে