সুদীর্ঘকাল ধরে খাদ্যের পাশাপাশি ওষুধের বিকল্প হিসেবে মধু ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত মধু খেয়ে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, কিন্তু তাদের অনেকেই হয়তো মধুর বহুমাত্রিক উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জানেন না। বিশ্বজুড়ে অনেকের প্রিয় খাদ্য মধুর ভালো-মন্দ ও সেটি খাওয়ার নিয়ম তুলে ধরা হলো ওকে নিউজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডট কম (oknews24bd.com) এর পাঠকদের জন্য।
বহুবিধ শারীরিক উপকারিতা ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে মধুর মধ্যে। শরীরের সামগ্রিক শক্তি ও তারুণ্য বাড়ায়। হাড় ও দাঁত গঠনে, মধুর গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড়, চুলের গোড়া শক্ত রাখে, নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভঙ্গুরতা রোধ করে। রক্তশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, এতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, যা রক্তশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
মধুর উপকারিতা
মধুর পুষ্টি নির্ভর করে ধরনের ওপর। সাধারণত এক টেবিল চামচ (২১ গ্রাম) মধুতে ৬৪ ক্যালোরি ও ১৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা থাকে। এর বাইরে সামান্য ফ্যাট, ফাইবার ও প্রোটিন থাকতে পারে এতে।
বেশ কিছু অনুপুষ্টি বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টও সামান্য পরিমাণে থাকে মধুতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক। ভালো মানের মধুতে ফেনোলিক অ্যাসিড ও ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা সুস্বাস্থ্যে সহায়ক হতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
চিনির পরিবর্তে উচ্চমানের মধু খাওয়ার ফলে হৃৎপিণ্ডের নানামাত্রিক উপকার হতে পারে। এটি হৃদরোগের বেশ কিছু ঝুঁকি কমানোয় সহায়ক হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, মধু অংশগ্রহণকারীদের ‘ক্ষতিকর’ এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে ‘ভালো’ কোলেস্টেরল এইচডিএল বাড়াতে সহায়তা করেছে মধু।
আয়ুর্বেদের মতো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষত নিরাময়ে ত্বকে সরাসরি মধু ব্যবহার করা হতো। মধুর ব্যাকটেরিয়ারোধী উপাদান এবং সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বৃদ্ধি রোধে এর সক্ষমতার কারণে এমনটি করা হতো।
উচ্চমাত্রায় চিনি ও ক্যালোরি থাকার পরও পরিশোধিত চিনির চেয়ে ভালো বিকল্প মধু। পরিশোধিত চিনিতে পুষ্টির উপাদান যেখানে প্রায় শূন্যের কোঠায়, মধু সেখানে ফেনোলিক অ্যাসিড ও ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জোগান দেয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৪৮ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, মধু রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ালেও চিনির মতো বৃদ্ধি করে না।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
পরিশোধিত চিনির চেয়ে ভালো বিকল্প হলেও মধু এমন পরিমাণে খাওয়া উচিত যাতে করে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। খাদ্যটির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিচে দেওয়া হলো।
উচ্চমাত্রায় চিনি ও ক্যালোরি থাকায় ওজন কমানোর অন্য ব্যবস্থা না নিলে মধু মুটিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। মধুতে উচ্চমাত্রার চিনি (যেটি দ্রুত হজম হয়) রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়াতে পারে, যা ক্ষুধা বাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে ওজন বাড়ানোয় প্রভাব রাখতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাড়তি চিনি ওজন বাড়া ও স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
গবেষণায় আরও বলা হয়, উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত খাবার স্থূলতা, প্রদাহ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, লিভার ও হৃৎপিণ্ডে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
অতিমাত্রায় চিনিযুক্ত খাবার বিষণ্নতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, এমনকি কিছু ধরনের ক্যানসারেও ভূমিকা রাখতে পারে।
১. অভিজ্ঞতা ও ল্যাবটেস্ট ছাড়া খাঁটি মধু পরীক্ষার কোনো মাধ্যম নেই। অনেক সময় ল্যাব টেস্টেও ভুল ফলাফল আসে।
২. লোকমুখে পরিক্ষার যত মাধ্যমের কথা শুনা যায় সবই ধারণানির্ভর। যেমন, চুন পরীক্ষা, আগুন পরীক্ষা, পিপড়া পরীক্ষা, পানি পরীক্ষা, কুকুর পরীক্ষা, ফ্রীজিং পরীক্ষা, গা গরম পরীক্ষা ও হাত গরম পরিক্ষা ইত্যাদি। এ সকল প্রচলিত ভুল পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে কখনও মধু খাটি-ভেজাল চেনা সম্ভব নয়।
৩. খাঁটি মধু পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো, মধুর পেছনের লোকটি সৎ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও সচেতন হওয়া। অর্থাৎ সৎ-বিশ্বস্ত, অভিজ্ঞ ও সচেতন মধু বিক্রেতা বা খামারি থেকে মধু সংগ্রহ করা।
খেয়াল রাখতে হবে শুধু সৎ হলেই হবে না। সচেতন ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। কেননা, সচেতন ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন না হলে সৎ হওয়া সত্ত্বেও নিজের অজান্তেই নিজে প্রতারিত হয়ে হাজারও কাস্টমার প্রতারিত হতে পারে।
৪. সব মধুর গুনাগুণ যেমন এক নয় তেমনি সব মধুর বৈশিষ্ট্যও এক নয়। একেক মধুর একেক বৈশিষ্ট্য। যেমন, সুন্দরবনের চাকের খাঁটি মধুর মধ্যে উপরের দিক দিয়ে প্রচুর পরিমাণ গাদ জমে। সরিষা, ধনিয়া, লিচু ও ধনিয়া মিক্স কালোজিরা ফুলের মধু জমে যায়। সুন্দরবনে মধুতে আদ্রর্তা কম থাকলে সুন্দরবনের চাকের মধুও জমে যেতে পারে। এগুলো মধুর বৈশিষ্ট্য। অনেক ভাই মনে করে মধু জমে গেলে মধু ভেজাল। এ ধারণা ঠিক নয়। বরং সরিষা, ধনিয়া, লিচু ও ধনিয়া মিক্স কালোজিরা ফুলের মধু জমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার এই চার প্রকার মধুর মধ্যে সরিষা ফুলের মধু অনেক বেশি জমে যায় তারপর ধনিয়া তারপর লিচু তারপর ধনিয়া মিক্স কালোজিরা ফুলের মধু।
সুতরাং মধু জমে গেলে ভেজাল এ ধারণা ঠিক নয়। এখন কথা হলো, জমে যাওয়ার পর নরমাল করার পদ্ধতি কী? হ্যাঁ, তাহলে শুনুন, জমা মধুর বোয়ামটা রোদে বা গরম করা পানিতে কিছুক্ষণ ধরে রাখলেই দেখবেন সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তবে জমা মধু খাওয়ার অভ্যাস করাই ভালো। আমাদের এ দেশে জমা মধুর কদর না থাকলেও বিদেশিদের কাছে এর কদর অনেক বেশি। তাঁরা জমা মধুকে ক্রীমহানি বলে।
৫. মধু প্লাস্টিকের বোয়ামে রাখার চেয়ে কাঁচের বোয়ামে রাখা নিরাপদ। এতে মধুর গুনাগুণ দ্বীর্ঘদিন অক্ষুন্ন থাকার সাথে সাথে মধুর রং ও গন্ধ অপরিবর্তিত থাকে।
অন্যথায় অল্প কিছু দিনেই মধুর গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যাবে।
মধু বেশি উষ্ণ বা বেশি ঠান্ডায় রাখা যাবে না। বরং মধু রাখতে হবে স্বাভাবিক জায়গায়। আর ভুলেও মধু ফ্রিজে রাখা যাবে না। এতে মধুর গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ ভুলটাই অধিকাংশ মানুষ বেশি করে। ফ্রিজ হল মধুর নাম্বার ওয়ান শত্রু। যেসব মধু জমে যায় সেসব মধু ফ্রিজে রাখলে খুব দ্রুত জমে যাবে।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ফ্রিজে মধু জমে যাওয়ার পর মধু ভেজালের হওয়ার জিকির করে। যা মুর্খতা বৈ কিছুই নয়।
খাঁটি মধুর খুচরা মূল্য তালিকা
খাটি সরিষা ফুলের মধু ১০০০ গ্রাম=৬০০টাকা
খাটি লিচু ফুলের মধু ১০০০ গ্রাম=৭০০টাকা
খাটি চাকের মধু ১০০০ গ্রাম=৮০০টাকা
খাটি পাহাড়ি চাকের মধু ১০০০ গ্রাম=৯০০টাকা
খাটি বড়ই ফুলের মধু ১০০০ গ্রাম=১০০০টাকা
খাটি সুন্দর বনের মধু ১০০০ গ্রাম=১০০০টাকা
খাটি কালজিরা ফুলে মধু ১০০০ গ্রাম=১২০০টাকা
আরো পড়ুন : নৃশংসতার সব নজির ছাড়াল ইসরাইল