নির্বাচনের ১০ দিন পেরিয়েছে। এখনো ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতা কমছে না। হামলা, মারধর, লুটপাট, বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছে ৩ শতাধিক। মাঠ প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতেও সহিংসতা কমছে না। মুন্সীগঞ্জ নাটোর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঝিনাইদহ, রংপুর, বরগুনা, বরিশাল, চাঁপাইনবাগঞ্জ, নওগাঁ, পঞ্চগড়সহ প্রায় ২৫ জেলার একাধিক স্থানে নির্বাচন পরবর্তী হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অনেকের হাত পা ভেঙে ও চোখ উপড়ে নেয়া হয়। গুরুতর আহত হয়ে অনেকে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
গত সোমবার আওয়ামী লীগের যৌথসভায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, দলের মধ্যে কোন্দল, সংঘাত ও বিভেদ নিরসনে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।
দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের পর কয়েক দফা এমন নির্দেশনা দিয়েছেন নেতারা।
গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র ও নৌকা সমর্থকদের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। অতীতে বড় দুই দল প্রতিপক্ষ থাকলেও এবার প্রতিপক্ষ নৌকার প্রার্থী আর ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা। কোথাও পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা হামলার শিকার হচ্ছেন। আবার কোথাও বিজয়ী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের ওপরও হামলা হচ্ছে।
নির্বাচনে স্বতন্ত্রদের কাছে আওয়ামী লীগের ৩ প্রতিমন্ত্রীসহ ১৯ জন হেভিওয়েট প্রার্থী পরাজিত হন। অনেকে জামানত হারিয়েছেন। এই আসনগুলোতেই বেশি হামলা, সংঘর্ষ চলছে। পরাজিত প্রার্থীরাও অনেকে এলাকাছাড়া।
মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক রিপোর্ট বলছে, ঝিনাইদহে ৪০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়িতে ৪০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টি, কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ১৫টি, ঝিনাইদহে ২০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ওই জায়গাগুলোর কোথাও দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথাও বলছে সংগঠনটি। এ ছাড়াও পিরোজপুর, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ, পটুয়াখালী এবং রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- বিজয়ী নৌকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগের নেতারা এই হামলা ও হুমকির সঙ্গে জড়িত। হামলা ও হুমকির ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হচ্ছে না। একাধিক পরাজিত প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। যারা বিজয়ী হয়েছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। যাদের ওপর হামলা হচ্ছে, তারাও আওয়ামী লীগের। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণে তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা মোটেও কাম্য নয়। তবে সহিংসতা নিয়ে অনেক সংগঠন হাজার হাজার বাড়িঘর ভাঙচুরের যে তথ্য দিচ্ছে তা অতিরঞ্জিত। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। এখানে নির্বাচনে যারা অংশ নিয়েছে দুই পক্ষই আওয়ামী লীগ দুই পক্ষের মতাদর্শও এক তাই দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করা উচিত না। যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে এই হামলা সহিংসতার ঘটনা কমে আসবে। আর তৃণমূল পর্যায়ে স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগ দ্বন্দ্ব বিভেদ দলের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তাই দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা উচিত বলে মনে করি।
যেখানে সহিংসতা ঘটেছে:
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক দম্পতি ইমান আলী ও কাজল রেখার ওপর রড দিয়ে হামলা হয়েছে। এ সময় ইমান আলীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার। কুমিল্লায় নৌকার পরাজিত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ মেরী অভিযোগ করেন, তার বহু কর্মী-সমর্থক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গাজীপুরে নৌকার পরাজয়ের পর থেকে কর্মী-সমর্থকদের মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুর-আগুন ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের বিজয়ী নৌকা প্রতীকের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। মঙ্গলবার এ সংঘর্ষ ঘটে।
কক্সবাজারের চকরিয়ায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আবুল কালাম নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। নির্বাচিত এমপি মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমের হাতঘড়ির পক্ষে ভোট করায় তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।
সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলা) আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সমর্থকদের হামলায় আহত হয়েছে আওয়ামী লীগের অর্ধশত নেতাকর্মী। ১৫ই জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা গাজী দেলখোশ আলী প্রামাণিকের পরিবারের ওপর হামলা চালানো হয়। আসনের মেঘুল্লা, তামাই, চালা, গাড়ামাসি, চন্দনগাঁতি, জিধুরী, সুরর্ণসাড়া, গোপালপুর, দেলুয়া, রাজাপুর ও বানিয়াগাঁতি এলাকায় নৌকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কুপিয়ে ও মারপিট করে অর্ধশত জনকে আহত করেছে। এ এলাকার প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমথর্করা।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে নির্বাচনে পরাজিত নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছেন বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী ফয়সাল বিপ্লবের সর্মথকেরা। ১৩ই জানুয়ারি সকালে সদর উপজেলার চরাঞ্চলের আধারা ইউনিয়নের সোলারচর ও বকুলতলা গ্রামে এই হামলার ঘটনা ঘটে। নৌকায় ভোট দেয়ায় ২ নারী ও ৩ পুরুষকে পিটিয়ে আহত করা হয়। বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে স্বর্ণালংকার নগদ টাকা ও গরু-ছাগল লুটে নেয়া হয়।
নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী) আসনে আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট শাহেদুজ্জামান পলাশকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ১৩ই জানুয়ারি রাতে সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব মির্জানগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে নেত্রকোনা-৩ আসনে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অসীম কুমার উকিল। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের কর্মী সমর্থকরা মিছিল বের করলে তাতে হামলা চালানো হয়। এতে একজন আহত হয়ে পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের হামলায় আহত নৌকার সমর্থক জিয়ার হোসেন ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সোমবার বিকাল ৫টায় তার মৃত্যু হয়।
পটুয়াখালী-৪ আসনের বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যাওয়ার পথে নৌকার ৭ কর্মীকে কুপিয়ে জখম করে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা । ৮ই জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী হাটখোলা বাজার সংলগ্ন মুজিব কিল্লা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নাটোরের বাগাতিপাড়ায় পরাজিত নৌকার প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকদের বাড়িঘর ও দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। নির্বাচনের পরদিন ৮ই জানুয়ারি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ২০টি বাড়িঘর ও দোকানে হামলা করা হয়।
ঝিনাইদহে নির্বাচনের পরদিন নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের অর্ধশতাধিক বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পরাজিত প্রার্থীকে ভোট দেয়ায় ভোটারদের বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। এ ঘটনায় নারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। ৮ই জানুয়ারি সদর উপজেলার পোড়াহাটি ইউনিয়নের বারইখালী, হীরাডাঙ্গা ও সুরাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সমর্থকদের ওপর অন্তত ১০ স্থানে হামলা করে। কর্মীদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়েছে। হামলা চালিয়েছেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুলের অনুসারীরা।
কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়েছে। আবার কোথাও ঘটেছে গোলাগুলির ঘটনা। এই আসনের নবনির্বাচিত এমপি আব্দুর রউফ এবং নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেই হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। ১২ই জানুয়ারি এ ঘটনা ঘটে।
কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু পরাজিত হওয়ার পরে তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা কামারুল আরেফিন লোকজন এ হামলা চালিয়েছে। নৌকার নির্বাচন করায় ১৩ই জানুয়ারি মিরপুর থানার মালিহাদি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মো. মিনার ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা চালিয়ে বেধড়ক মারধর করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা।
আরো পড়ুন : উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, তকে চক্রান্ত শেষ হয়নি