মাছ কেনার সাধ্য নাই, মাথাই আমগো ভরসা

অর্থনীতি ওকে নিউজ স্পেশাল প্রচ্ছদ লাইফ স্টাইল

কারওয়ান বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে শেষমেশ দুটি কাতলা মাছের মাথা কেনেন নাছরিন বেগম। প্রতিটি মাথা বিক্রেতা ৪০ টাকা চাইলে দরকষাকষি করে তিনি দুটির দাম দেন ৭০ টাকা। পরে তা পলিথিনে ভরে বাসার দিকে রওনা দেন নাছরিন। মাছ না কিনে শুধু মাথা দিয়ে চলবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিন দোকানে তেলাপিয়া দেখলাম। যে দাম চাইলো তাতে কেনার সাধ্য নাই, মাছের মাথাই আমগো ভরসা।’ স্বামী পঙ্গু। তাই দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার খরচ চালাতে হয় নাছরিনকেই। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা কারওয়ান বাজারে সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করে। আমি বাসাবাড়িতে কাম করি। এ আয় দিয়েই চলি। মাছ কিনবো ক্যামনে।’

গতকাল সোমবার বিকেলে কারওয়ান বাজারে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে মাছের মাথা বিক্রি করছিলেন স্বপন। এসব মাথা কারা কেনেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেন, মাছের দাম বেশি হওয়ায় এখন কমবেশি সব শ্রেণির মানুষই মাথা কিনতে আসেন।’ স্বপনের কথার সত্যতা মিলল ওই দোকানের পাশে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে। শুধু নাছরিন নন, মেসের অনেক ব্যাচেলরও মাছের মাথা কিনছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অনেকেই মাছের বদলে তিন-চারটা করে মাথা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

দেশে গত আট বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। আমদানিও হচ্ছে কোটি কোটি ডলারের মাছ। তবু কমছে না দাম, উল্টো বাড়ছে। রোজার ছুতায় ব্যবসায়ীরা আরেক দফা দাম বাড়িয়েছেন। সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসা পাঙাশ, তেলাপিয়া, সিলভারকার্প ও কই। তবে এসব জাতের মাছও এখন দামি।

গতকাল রাজধানীর তেজকুনিপাড়া, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুলসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় আকারের প্রতি কেজি পাঙাশ ২০০ থেকে ২৪০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও এসব মাছ ২০০ টাকায় কেনা যেত। তবে ছয় মাস আগে এসব মাছ ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে মিলত। একইভাবে চাষের কইয়ের কেজি মাস দুয়েক আগে ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, যা এখন কিনতে লাগছে ২০০ থেকে ২৭০ টাকা। সিলভারকার্পও বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৪০ টাকার মধ্যে।

রোজার ছুতায় রুই, কাতলা, পাবদা, চিংড়ি, ইলিশের দাম আরও বেড়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বড় আকারের রুই ও কাতলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। আর ছোট আকারের রুই-কাতলার কেজি পাওয়া যাচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে আকারভেদে পাবদা ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বেড়ে মাঝারি সাইজের শিং মাছ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

হাতিরপুল বাজারের মনির মৎস্য বিতানের বিক্রয়কর্মী বলেন, গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। রাস্তায় ও বাজারে কত রকম খরচ আছে। ঘাটেও দাম বেড়েছে। এ কারণে খুচরা বাজারে কিছুটা বাড়তি। তিনি বলেন, বাজারে তেল, চিনি, চাল, ডাল– সব কিছুরই দাম বেশি। মাছ বিক্রেতাদেরও তো সেসব সদাই কিনতে হয়। এখন মাছ বিক্রি করে যে লাভ হয়, তা অন্য জিনিসের দামে খেয়ে ফেলে।

তবে দাম বেশি বেড়েছে চিংড়ি ও ইলিশের। আট-দশ দিনের ব্যবধানে চিংড়ি কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। ছোট চিংড়ির কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ এবং বড় চিংড়ির কেজি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ইলিশে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আকারভেদে ইলিশের দাম কেজিতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়। আর ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এ ছাড়া এক কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা দুলাল চন্দ্র দাশ বলেন, দুই মাস ধরেই ইলিশের দাম বেশি। বাজারে আমদানি কম হলে দাম বেশি থাকে।

বোয়াল, আইড়, চিতলসহ নদী ও সাগরের অনেক মাছের দাম শুধু নিম্নবিত্ত নয়, নিম্ন­-মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এসব মাছের দামও কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা বেড়েছে।

দাম বৃদ্ধির চিত্র দেখা গেছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও। সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত বছরের এই সময় রুই মাছের কেজি ছিল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ১০০ টাকা। শতাংশের হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রুইয়ের দাম ৩৩ এবং ইলিশের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে।

দেশে তিনটি উৎস– মুক্ত জলাশয়, চাষ ও সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এ তিনটি উৎস থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৬ দশমিক ৬৪ লাখ টন। আট বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ দশমিক ৮৪ লাখ টন। এর মধ্যে চাষের মাছের উৎপাদন বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে চাষ করা মাছের উৎপাদন ছিল ২০ দশমিক ৬০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৫৫ লাখ টনে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশকে বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থাটির ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান ধরে রেখেছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। এ ছাড়া তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের।

এ ছাড়া ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর মাছ আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সাগর পথে ৬৫ হাজার ৩৮৮ টন হিমায়িত মাছ আমদানি হয়েছে, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ হাজার ৭৩১ টন বেশি। ওই অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫২ হাজার ৬৫৭ টন।

এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মাছ কেনার সামর্থ্য হারিয়ে মানুষ এখন মাছের মাথা কিনছে। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা মানুষ আমিষের অভাব পূরণে ভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে সরকারকে আশু উদ্যোগ না নিলে পুষ্টিহীনতা প্রকট আকার ধারণ করবে।

আরো পড়ুন : ভালাহাটে ২১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিতরণ

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *