মাদক নির্মূল করতে গিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে ডিএনসি’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ দুর্নীতি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচ্ছদ হ্যালোআড্ডা

* এক বছরে ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা * ১৯ জনের লঘুদণ্ড, ১১ জনকে অব্যাহতি, ৮ মামলা চলমান * কুষ্টিয়ায় জব্দ করা গাঁজা বিক্রি করে দিলেন তিন কর্মকর্তা

মাদক নির্মূল করতে গিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। আসামি ও তাঁদের স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন– কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে এমন অভিযোগও। কেউ কেউ অবৈধভাবে বিক্রি করে দিচ্ছেন জব্দ করা মাদক। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগও রয়েছে। এসবের কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব একটা নেই। অপরাধ করেও পার পাচ্ছেন অনেক ‘প্রভাবশালী’ কর্মকর্তা। তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য। তবে ডিএনসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হয়। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শেষে ২০২২ সালে ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে ডিএনসি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০ মামলা। শুধু ১৯ জনের বিরুদ্ধে নামকাওয়াস্তে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাস্তি হিসেবে কারও হয় ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, কারও করা হয় তিরস্কার। বাকি ১১ জন অব্যাহতি পান। আটটি মামলা এখনও চলমান।

জব্দ গাঁজা বিক্রি : গত ২৩ নভেম্বর মিল্টন শেখ নামে কুষ্টিয়ার এক মাদক কারবারি প্লাস্টিক পণ্যের আড়ালে গাঁজা বহন করছিলেন। ডিএনসির কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল শহরের মজমপুর থেকে মিল্টনকে আটক ও তার কাছে থাকা বস্তায় তল্লাশি চালায়। নতুন প্লাস্টিকের জগের ভেতর থেকে প্রায় ছয় কেজি গাঁজা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ আবুল কাশেম বাদী হয়ে ওই দিন কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করেন। প্রায় ছয় কেজি গাঁজা জব্দ করা হলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে তিন কেজি। বাকি গাঁজা অবৈধভাবে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঘটনাটি জানাজানির পর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক পারভীন আখতার তদন্ত করেন। জব্দ করা গাঁজা বিক্রি করে দেওয়ার তথ্য উঠে আসে তদন্তে। জড়িতরা হলেন– পরিদর্শক বেলাল হোসেন, উপপরিদর্শক শেখ আবুল কাশেম ও হাফিজুর রহমান। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের দু’জন পরিদর্শক বেলাল হোসেন ও উপপরিদর্শক আবুল কাশেম কুষ্টিয়া কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। অপর অভিযুক্ত উপপরিদর্শক হাফিজুর রহমানকে বরগুনায় বদলি করা হয়েছে।

উপপরিচালক পারভীন আখতার বলেন, তদন্তে যে তিনজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সেই সাজ্জাদ : রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের কুড়াতলী এলাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ডিএনসির গুলশান সার্কেলের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে এবার ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ মিলেছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সুলপিনা গ্রাম থেকে আলী আহম্মদসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেন এসআই সাজ্জাদ ও তার দল। রাতে তাঁদের নেওয়া হয় ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তরের তেজগাঁও কার্যালয়ে। গুলশান সার্কেলে কর্মরত ফয়সালের বিকাশ নম্বর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন এসআই সাজ্জাদ। নিশ্চিত হওয়ার অন্তত ২০ মিনিট পর সাজ্জাদ তাঁকে বলেন, তোমার বিকাশে ২০ হাজার টাকা এসেছে, টাকাগুলো উঠিয়ে আনো। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে তেজগাঁও কলোনি বাজারের একটি এজেন্ট থেকে ওই টাকা তুলে সাজ্জাদের হাতে দেন ফয়সাল। ২০ হাজার টাকা সাজ্জাদ আসামি আলী আহম্মদের সেজো ভাই হারেস আহম্মদের কাছ থেকে আনিয়েছিলেন।

আলী আহম্মেদের বড় ভাই নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘আলীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে এক কর্মকর্তা আমার মেজো ভাইয়ের কাছে (হারেস) ফোন করে ২০ হাজার টাকা চান। বিকাশ নম্বরে টাকা দেওয়ার পরও আলীকে ছাড়া হয়নি। পরে শুনি আলীকে গাঁজার মামলায় চালান করে দিয়েছে। আমার ভাই কৃষিকাজ করে। গাঁজা খায়ও না, বেচেও না।’ আলীর কাছে ১০০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন সাজ্জাদ। রূপগঞ্জ এলাকা থেকে ধরে আনলেও গ্রেপ্তারের স্থান দেখানো হয়েছে কুড়িল বিশ্বরোডের অদূরে কুড়াতলী।

ঘুষের বিষয়ে পরে ডিএনসির মহানগর উত্তরের উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামানকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন আসামির লোকজন। রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘আমি শুনেছি এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। তবে লিখিত অভিযোগ পাইনি। পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।’

তরুণীকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। সাজ্জাদ এখনও গুলশান সার্কেলে একই পদে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। অবশ্য তরুণীকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল প্রথমদিকে। এ ঘটনায় গত ৫ ডিসেম্বর সমকালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে এবং মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ওই তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চার মাস কারাভোগের পর জামিনে বের হন তিনি।

পার পেলেন বড় কর্তারা : গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানার মধ্য আরিচপুরের আশরাফুল আলম পল্টনকে ২০২২ সালের ১৪ জুলাই গ্রেপ্তার এবং তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার ঘটনায় পার পেয়ে যান অভিযানে অংশ নেওয়া দুই কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন– ডিএনসির সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ ও মতিঝিল সার্কেলের পরিদর্শক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এই দুই কর্মকর্তাসহ ৯ জন আভিযানিক দলে অংশ নিয়েছিলেন। অথচ তদন্তে দোষারোপ করা হয় আভিযানিক দলে অংশ নেওয়া সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোহাম্মদ হোসেন এবং সে সময় ছুটিতে থাকা উপপরিদর্শক তাজবীর আহাম্মদকে। তদন্ত প্রতিবেদন অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি গঠনের পর সুব্রত সরকার ও মিজানুর রহমান অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন দু’জন কর্মকর্তার কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। পরে তদন্তে তাঁদের নাম আসেনি।

সোনার বার আত্মসাৎ : নীলফামারীতে জব্দ করা ১০টি সোনার বার আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ডিএনসির সিপাহি মেহেদী হাসানকে বরখাস্ত করা হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা কার্যালয়ের একটি আভিযানিক দল সৈয়দপুর-রংপুর মহাসড়কের কামারপুকুর এলাকায় মাদক আছে সন্দেহে একটি বাস থামায়। তল্লাশি চালিয়ে যাত্রী আব্দুর রহিমের কাছ থেকে ১৫টি সোনার বার জব্দ করে। রহিম ও মোহাম্মদ উল্লাহ নামে আরেকজনকে আটক করে সরকারি গাড়িতে বসিয়ে রেখে সিপাহি মেহেদী হাসানের হেফাজতে দেন কর্মকর্তারা। এ সুযোগে মেহেদী আটক মোহাম্মদ উল্লাহর দেহ তল্লাশি করে আরও ১০টি সোনার বার উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দেন।

তদন্তে কচ্ছপগতি : যাত্রাবাড়ী থেকে আব্দুল্লাহ আল তানভির নামে এক যুবককে গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে নেওয়া হয় ডিএনসির গেণ্ডারিয়ায় ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে। মামলায় ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ কম দেখানোর কথা বলে আসামির লোকজনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন আভিযানিক দলের সদস্যরা। টাকা না পেয়ে নির্যাতন করা হয় তানভিরকে। তার স্মার্টফোনও গায়েব করে দেওয়া হয়। আভিযানিক দলে ছিলেন ডিএনসির ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ রিফাত হোসেন, পরিদর্শক মাসুদুর রহমান, উপপরিদর্শক ইকবাল আহম্মদ দীপু, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আতাউল হক, সিপাহি সোহেল রানা, মোহাম্মদ আবু হানিফ ও গাড়িচালক আব্দুর রহিম। এ ঘটনায় ডিএনসি থেকে কমিটি করা হলেও তদন্ত শেষ হয়নি আজও।

তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসির নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন বলেন, অন্য কাজের চাপে তদন্ত শেষ করার সুযোগ পাচ্ছি না।
ডিএনসির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, যখন যে অভিযোগ আসছে তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

সুত্র-সমকাল

আরো পড়ুন : খরচের চাপে খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলল নিম্ন আয়ের মানুষ

 

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *