ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে : ছেলে সোহেল রানা (৩৫)কে হত্যা করা হয়েছে। তাও আবার প্রবাসে। ছয় মাস আগেই এ খবর পান মা আমিনা বেগম। সেই থেকে ছেলের কথা মনে হলেই কখনো হাউমাউ করে, আবার কখনো নীরবে চোখ ভেজান তিনি। দীর্ঘ ৬ মাস পর সব প্রক্রিয়া শেষে শনিবার কফিনবন্দি হয়ে সোহেল বাড়ি ফেরেন। সোহেলের মায়ের আহাজারিতে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। ছেলের শোকে বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছেন তিনি। সোহেলের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দক্ষিণ ধলাপাড়া গ্রামে। পিতা আহমদ মিয়া মারা গেছেন বহুদিন আগে। স্বামী হারানোর পর একমাত্র সন্তান সোহেলকে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছেন মা আমিনা বেগম।
অল্প বয়সে বিধবা হলেও সন্তানের কথা চিন্তা করে তিনি আর বিয়ে করেননি। প্রিয় সন্তানকে ঘিরেই তার ছিল সকল সুখ, দুঃখ, আশা, ভরসা।
সোহেলের স্বজন ও এলাকাবাসী জানান, মালয়েশিয়ায় অপহরণের শিকার হয়েছিলেন সোহেল। যারা তাকে অপহরণ করেছিল, তারা ভিনদেশি কেউ নন, তার নিজের দেশেরই। অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেছিল পাঁচ লাখ টাকা। না দিলে একমাত্র ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। বাবাহারা ছেলের জীবন বাঁচাতে টাকা পাঠান মা। তবুও হত্যা করা হয় সোহেলকে। এদিকে, একমাত্র ভাইকে হারানোর কষ্ট কিছুতেই সইতে পারছেন না বোন পারভীন খাতুন। ভাইয়ের কফিনের পাশে বসে বিলাপ করে কান্না করছিলেন তিনি।
পারভীন খাতুনের স্বামী বিল্লাল হোসেন জানান, অল্প বয়সে বাবাকে হারান সোহেল। পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে বড়বোন পারভীন খাতুন আর মাকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে ১৫ বছর আগে পারি জমান মালয়েশিয়ায়। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে লেখাপড়া খুব একটা করা হয়নি। সোহেল মালয়েশিয়ায় একটি কারখানায় কাজ করতেন। গত বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাতে তামিলজায়া এলাকায় তার বাসার সামনে থেকে সোহেলকে অপহরণ করা হয়। মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা তার মোবাইলে ফোন করেন। ওইদিনই অপহরণকারীদের দেয়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরও মিললো না মুক্তি। মিজানুর রহমান নামে সোহেলের এক মামা থাকেন মালয়েশিয়ায়। মিজানুরের দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে বিল্লাল হোসেন জানান, টাকা দেয়ার পর মুক্তি না দেয়ায় মালয়েশিয়ার কাজং থানায় একটি মামলা করেন মিজানুর। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ওই চার প্রবাসী বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাদের দেয়া তথ্য ও স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত ৬ই অক্টোবর রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে জায়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক এলাকার একটি জঙ্গল থেকে সোহেলের হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ আটকানো অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে অজ্ঞাত আসামি করে বিল্লাল হোসেন বাদী হয়ে ঘাটাইল থানায় মামলা করেন।
পুলিশের দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে বিল্লাল হোসেন জানান, মুক্তিপণের টাকা দিতে অপহরণকারীরা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের যে অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়েছিল সেই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম নাছির উদ্দিন। বাড়ি বরিশাল জেলায়। সেই নাছির উদ্দিন জানান, মালয়েশিয়া প্রবাসী তার বন্ধু মামুন নাকি তার অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। সোহেলের চাচি ছাহেরা বেগম বলেন, চলতি বছর ছুটি নিয়ে দেশে আসার কথা ছিল সোহেলের। এসে বিয়ে করবে এমন কথা ছিল। ভাতিজা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনিসহ এলাকাবাসী। স্থানীয় ইউপি সদস্য শামীম আল মামুন মানিক বলেন, টাঙ্গাইল থেকে সিআইডি পুলিশের একটি টিম এসে জানালেন মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে হবে। তাই লাশ তারা নিয়ে গেছেন। টাঙ্গাইল সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক শাখাওয়াত হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ঘাটাইল থানায় করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত করার জন্য মরদেহ আনা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।