ঢাকায় খুনের একটি মামলার তদন্তে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। খুনের শিকার হওয়া এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হওয়ার পর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাঁদের মধ্যে দুজন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। কিন্তু যাঁকে হত্যার কথা তাঁরা স্বীকার করেছিলেন, পরে দেখা গেছে ওই ব্যক্তি মারা যাননি, তিনিই এ হত্যাকাণ্ডের আসল খুনি।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের দায় দেখছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান। তিনি বলেছেন, ‘একজন আসামি আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়ে বললেন, তিনি খুনের সঙ্গে জড়িত। পরে দেখা গেল, তিনি খুনে জড়িত নন। এর অর্থ হচ্ছে, আসামিকে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। আমাদের দেশে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।’ নূর খান আরও বলেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে তদন্তে গুরুতর অবহেলার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে সাড়ে পাঁচ বছর আগে। ২০১৭ সালের ২০ মে পুরান ঢাকার কদমতলী থানা-পুলিশের কাছে খবর আসে, একটি মরদেহ খুপরি ঘরে পড়ে আছে।
পরে পুলিশ সদস্যরা কদমতলীর ঢাকার ইগলু আইসক্রিম কারখানার সামনের খুপরি ঘরে মরদেহটি দেখতে পান। তবে মরদেহে এতটা পচন ধরেছিল যে চেনার উপায় ছিল না। পরে পুলিশ খোঁজখবর নিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করে। তাতে কে খুন হন, সেটি আর উল্লেখ করা হয়নি।
পরে পুলিশ খুন হওয়া ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধারে মাঠে নেমে পড়ে। পাশাপাশি খুনি গ্রেপ্তারে অভিযান চলে। পরে বিল্লাল হোসেন ও জালাল ওরফে শাহজালাল নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তি দেন, সেদিন খুন হয়েছিলেন ইমরান। আর খুনে জড়িত ছিলেন মজিবর, সুমন, শুভ, জুয়েল ও কামরুল।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁরা উল্লেখ করেন, মজিবর ইমরানের বুকের ওপর উঠে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। খুনের কারণ ইমরানের সঙ্গে মাদক ব্যবসা নিয়ে মজিবরের বিরোধ। জবানবন্দিতে খুনি হিসেবে যাঁদের নাম উঠে আসে, তাঁদের প্রত্যেককে (ছয়জন) গ্রেপ্তারও করা হয়। অপর চারজন হলেন রাসেল, সুমন দেওয়ান, মহিন ও জামাল হোসেন ওরফে জামাল।
তবে পুলিশ যখন খুন হওয়া ইমরানের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা খুঁজতে ভোলায় যায়, তখন আগের বিবরণ উল্টে যায়। পুলিশ তখন জানতে পারে, কদমতলীতে যে যুবক খুন হয়েছিলেন, তিনি ইমরান নন। ইমরান বেঁচে আছেন। সেদিন খুন হয়েছিলেন আসলে মজিবর, যিনি ইমরানের সঙ্গে ওই খুপরি ঘরে থাকতেন।
ভোলার আরেকটি খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ইমরান তখন কারাগারে। পরে গত বছরের ১০ মার্চ ইমরানকে মজিবর খুনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ইমরান মজিবরকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে ঢাকার আদালতে জবানবন্দিও দেন। তাতে উঠে আসে মজিবর খুনের কাহিনি।
ইমরান জবানবন্দিতে বলেছিলেন, দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা ইমরান ছয় বছর আগে ভোলা থেকে ঢাকায় আসেন। শুরু করেন বুড়িগঙ্গার তীরে বালু ও ইট টানার কাজ।
পরিচয় হয় জামালের সঙ্গে। জামালের ঘরে থাকতেন ইমরান। একই ঘরে থাকতেন মজিবর। ২০১৭ সালের ২০ মে। রাত সাড়ে ১১টা। জামালের ছাপরা ঘরে ইমরান আর মজিবর শুয়ে ছিলেন। বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎ ছিল না। তখন জামালের ঘরে আসেন কালা সুমন, মহিনসহ কয়েকজন। বাকিরা মজিবরের হাত ও পা ধরেন।
একজন ঘরে থাকা শিল পাটা দিয়ে মজিবরের মাথায় আঘাত করেন। পরে মজিবরের মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রাসায়নিক ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তখন মজিবরের মুখমণ্ডল চেনার কোনো উপায় ছিল না। পরে সেখানে মৃতদেহ রেখে যে যার মতো পালিয়ে যান।
এ মামলায় পাঁচ বছর সাত মাস তদন্তের পর সম্প্রতি ঢাকার আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশও বলেছে, মজিবরই খুন হয়েছিলেন। তাঁর দুই সন্তানের ডিএনএর সঙ্গে মজিবরের ডিএনএর মিল পাওয়া গেছে। আর মজিবরকে খুন করেছিলেন একা ইমরান। মজিবর যে ঘরে খুন হন, সেটির মালিক ছিলেন জামাল। ওই ঘরে ভাড়া থাকতেন ইমরান। জামালের ঘরে মজিবর, সুমন, মহিনদের যাতায়াত ছিল। সুমন মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। মজিবরের স্ত্রী দেশের বাইরে থাকতেন। তিনি সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। মাদক সেবন করতেন। সবাই জামালের ছাপরা ঘরে আড্ডা দিতেন। ওই ঘরে ইমরানের পাশাপাশি মজিবরও থাকতেন। মাদক ব্যবসায় ইমরানের যে আয় হতো, তা জামালের ঘরে রাখতেন তিনি। ইমরান সন্দেহ করতেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে মজিবর টাকা চুরি করেন। এ নিয়ে বিরোধের জেরে ইমরানের সঙ্গে মজিবরের মারামারি হয়। ওই রাতে মজিবর ইমরানের জামাকাপড় পরে ঘুমিয়ে ছিলেন। পরে রাত ১১টার দিকে ঘুমিয়ে থাকা মজিবরকে শিলপাটা দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন ইমরান। এরপর কৌশলে ঢাকা থেকে ভোলায় চলে যান তিনি। পরে চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মঈনুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, জামালের ঘরে সেদিন মজিবর ইমরানের পোশাক পরে শুয়েছিলেন। আবার মরদেহে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ায় চেনার উপায় ছিল না। তখন কদমতলী থানা–পুলিশসহ অন্যরা মরদেহটি ইমরানের বলে সন্দেহ করেন। পরে পুলিশ এই খুনে যাঁদের গ্রেপ্তার করে, সবাই ইমরানকে খুনে জড়িত থাকার কথা বলেন। তবে দীর্ঘ তদন্ত ও ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ইমরানই মজিবরকে খুন করে পালিয়ে যান। এ জন্য ইমরানকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। তবে ইমরানের আইনজীবীরা আদালতে দাবি করেছেন, তাঁদের মক্কেল মজিবর খুনে জড়িত নন। তিনি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চান।
আরো পড়ুন : জেনে নিন কোন ৫টি অভ্যাস সম্পর্কের বুনন দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে