নিজস্ব প্রতিবেদক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নামমাত্র মূল্যে বসতভিটা বিক্রি না করার জেরে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই মিজানুর রহমানের নির্দেশে ওসমান গণি স্বাধীন নামে ৯ বছরের এক শিশুকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে শিশুটির পরিবার।
স্বজনদের দাবি, শিশুটির মরদেহ যেন শনাক্ত করা না যায় এজন্য থেঁতলে দেওয়া হয়েছে তার মুখ, এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়েছে শরীর। এমনকি মরদেহ গুম করতে হত্যার পর তা ফেলে দেওয়া হয় নদীতে।
অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় হত্যা মামলা না নিয়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে অভিযোগ করে স্বাধীনের পরিবার বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি তুলে ধরে শিশুটির পরিবার।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনের বাবা শাহিনুর রহমান শাহীন, মা উম্মে হানি মুন্নী ও দাদা রেজাউল করিম। তারা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের বাসিন্দা।
শাহিনুর রহমান শাহীন বলেন, গত ৪ ডিসেম্বর ইদারকান্দি গ্রামে নির্মাণাধীন ব্রিজের নিচে বালু নদী থেকে ৯ বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আমি সেই শিশুটির হতভাগ্য পিতা। আমার অবুঝ সন্তানের মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল না, তাকে নৃশংসভাবে খুন করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
প্রভাবশালীর নির্দেশে শিশু স্বাধীনকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সন্তানের হত্যাকারী আমাদের ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক রফিকুল ইসলাম ওরফে আন্ডা রফিক এবং তার ভাই মিজানুর রহমান ওরফে কুত্তা মিজান। তারা এত প্রভাবশালী যে, সন্তানকে কবর দেওয়ার পর আমরা বাড়িতে থাকতে পারি না। আর বিচার কীভাবে পাব?
‘তাদের লোকজন আমার সন্তানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বললে আমাদেরও মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। বাড়িতে পাহারা বসিয়েছে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাড়ি থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সন্তান হত্যার বিচার পেতে আমরা মামলাও করতে পারিনি, থানা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে অপমৃত্যুর মামলার পরামর্শ দেয়। ’
হত্যাকাণ্ডের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম গত দুই মাস আগে আমাদের বাড়ি নামমাত্র দামে কিনতে তার বোনকে পাঠান। তার সঙ্গে আরেকজন নারীও ছিলেন। তারা আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলাম কিনতে চান বলে জানালে আমার বাবা রেজাউল করিম বলেন, বাড়ি বিক্রি করলে আমরা থাকবো কই। তারপরও যদি কখনো বিক্রি করি আমি নিজেই রফিক সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবো, তোমাদের আর কষ্ট করে আসতে হবে না।
‘বাড়ি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ার পর থেকে রফিকুল ইসলাম ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, চাঁদাবাজি শুরু করেন। তারা একাধিকবার আমাদের বাড়িতে হামলা করেছেন। আমাদের দোকানে দুই দফা হামলা এবং আমার বাবা ও আমার ওপর হামলা করেন। পরে আমার নাওড়া পাড়ার মুদি দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তারপরও আমরা বাড়িটি বিক্রি করতে রাজি হইনি।’
শাহীন বলেন, আমার সন্তানকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে রফিকুলের ভাই মিজানুর রহমান ‘উচিত শিক্ষা দেবেন’ বলে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যান। ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমার সন্তানটি নিখোঁজ হয়। এরপর আমরা স্বাধীনের বীভৎস লাশ পাই।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বাড়িটি রফিকুল ইসলামকে দিয়ে দিলে আমার শিশু সন্তানটির এমন করুণ পরিণতি হতো না। রফিকুল ইসলাম আমার জায়গার জন্য এমন জঘন্য কাজ করবেন, সেটা বুঝতে পারলে অনেক আগেই বাড়িটা দিয়ে দিতাম।
স্বাধীনের বাবা আরও বলেন, শিশু সন্তানের লাশ যাতে শনাক্ত না করা যায়, সেজন্য পুরো মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীর এসিড জাতীয় কিছু দিয়ে ঝলসে দেওয়া হয়েছে। পরনের প্যান্ট দেখে আমরা ওসমান গণিকে শনাক্ত করি।
তিনি বলেন, গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমার স্বাধীন নিখোঁজ হলে আত্মীয়-স্বজনরা মিলে অনেক খোঁজাখুজির পরও তাকে পাইনি। এরপর রাত ৮টার দিকে তার সন্ধান চেয়ে মাইকিং শুরু করলে রফিকুল ইসলামের লোকজন বাধা দেয়। তারা বলে, রফিকুল ইসলামের নির্দেশ এ বিষয়ে কোনো মাইকিং করা যাবে না।
‘এছাড়া রফিকুল ইসলামের লোকজন লাশ উদ্ধারের আগ পর্যন্ত আমাদের বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করতে থাকে। একবার বলে অমুক জায়গায় দেখছি, আবার বলে অন্য জায়গায় দেখেছি। এখন তারা সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে, আমার সুস্থ-সবল সন্তানটি নাকি প্রতিবন্ধী ছিল। সে পানিতে পড়ে মরে গেছে। ’
শাহীন বলেন, আমার সন্তানের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়ি নিয়ে আসি। বাড়িতে এসে দেখি রফিকুলের লোকজন হুজুর নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাড়িতে গাড়ি আসার পর তারা স্বাধীনের কাছে আর আমাদের যেতে দেয়নি। আমার সন্তানের মরদেহটাও শেষবারের মত কাউকে দেখতে দেয়নি। রফিকুল ইসলামের নির্দেশে পরিবারের অনুমতি না নিয়েই রাতের অন্ধকারে আমার শিশুটিকে কবর দেয়।
হতভাগ্য এ বাবা বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার করুন, যাতে এসব বর্বর, জানোয়ার, পাষণ্ড মানুষ নামের পশুগুলো আর কারও অবুঝ সন্তানকে খুন করার সাহস না পায়। আর কারও মায়ের বুক যাতে খালি না হয়।
তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে আমাদের করা অভিযোগটি আমরা চাই সিআইডি নতুবা পিবিআই তদন্ত করুক। আমাদের বিশ্বাস সিআইডি বা পিবিআই তদন্ত করলে হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য উদঘাটন হবে ও প্রকৃত অপরাধীরা শনাক্ত হবে।
স্বাধীনের দাদা রেজাউল করিম বলেন, আমার বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান আছে। রাতে দোকানে শুয়ে আছি, আড়াইটা-তিনটার দিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কিছু লোক এসে আমার দোকানে ভাঙচুর করে, দোকানের শাটারে শাবল দিয়ে আঘাত করে। বাড়ি গিয়ে গালিগালাজ করে আমার ছেলেকে বের হয়ে আসতে বলে। তখন আমার স্ত্রী ছেলেকে বলছিল তারা এমন করছে কেন, মিজানকে ফোন দে। তখন তারা বলে আমরা কি মিজানের অর্ডার ছাড়া এখানে আসছি নাকি? তারা আমার ছেলেকে ঘর থেকে বের করেছে। আমার স্ত্রী এসে তাদের পা ধরে মাফ করে দিতে বলছে।
রেজাউল করিম জানান, ওই ঘটনার ১০-১৫ দিন পর তার ছেলেকে দোকানে গিয়ে মারধর করা হয়। এছাড়া, প্রায়ই তারা এসে টাকা নিয়ে যেতো, দোকানের মালামাল নিয়ে যেতো। ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শিশু স্বাধীন পাশের বাড়ি থেকে বিয়ের দাওয়াত খেয়ে আসে। এসে স্বাধীন তার দাদীর সঙ্গে কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর আর তার নাতির খোঁজ নেই বলে কাঁদতে থাকেন এই বৃদ্ধ।
তিনি বলেন, আমি আমার নাতি হত্যার বিচার চাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে। রফিকের লোকজনের অত্যাচারে এলাকার কতো হিন্দু-মুসলমান এখন ঘরছাড়া। সবাই তাদের কাছে জিম্মি। একটা মানুষও ভয়ে কথা বলতে পারে না। আমি আমার নাতির হত্যার বিচার চাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাদের ৩৫ শতাংশ একটা বাড়ি আছে যেটা বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া। আরেকটা বাড়ি আছে পৌনে ৮ শতাংশ, যেটা তিনি নিজে কিনেছেন।
রেজাউল করিম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বাড়ির জন্য তারা আমার শিশু নাতিটাকে মেরে ফেললো।
স্বাধীনের মা উম্মে হানি মুন্নী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তারা আমার এই শিশুটারে কেন মারলো, তার কী অপরাধ ছিলো। সে তো কিছু বোঝে না। একটা শিশুরে এমন কইরা মানুষ কেমনে মারতে পারে? রফিক ও তার ভাই মিজান গুণ্ডাবাহিনী দিয়া আমার পোলাটারে মারছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে শাহীন বলেন, বাড়িতে হামলা চালানো সবাই রফিক ও মিজানের লোকজন। বাড়ি না দেওয়ার কারণে তারা আমাকে মারধর করে। এলাকায় এমন আরও ঘটনা ঘটলেও ভয়ে কেউ মামলা করার সাহস করে না। থানাও মামলা নেয় না।
এমনকি শিশু স্বাধীন নিখোঁজ হওয়ার পর তার লোকজন মসজিদের মাইক দিয়ে মাইকিংও করতে দেয়নি অভিযোগ করে শাহীন বলেন, মসজিদের হুজুর বলেছেন, রফিক-মিজানের লোকেরা তাকে মাইকিং করতে দিতে নিষেধ করেছে।
আরো পড়ুন : ১৬ ডিসেম্বর যেসব সড়ক এড়িয়ে চলতে হবে